Friday 15 July 2016

ইন্টারন্যাশনাল তোলাবাজ


কেল্টু কেমন ছেলে সেটা আর নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবে না! সুবোধ বালক বলে তার নামে কেউ কোনদিন কোনো দুর্নাম রটায়নি। তার অত্যাচারের শিকার হয়নি এমন কোনো ছেলে হোস্টেলে আছে বলে মনে হয় না! রান্নার ঠাকুর থেকে বাগানের মালী, এমনকি সুপারিনটেন্ডেন্টবাবুও বাদ যেতেন না। তবে সবচেয়ে বেশি অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে নন্টে আর ফন্টেকে।

প্রথম প্রথম হোস্টেলের সবার টিফিনে সে জোর করে ভাগ বসাতো। রান্নার ঠাকুরকে চমকে রান্নাঘর থেকে খাবার সরাতো। তবে যেদিন থেকে সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব সেই কেল্টুকেই হোস্টেলের মনিটর করে দিল, সেদিন থেকেই কেল্টুর দৌরাত্ম্য লাগামছাড়া হয়ে গেলো। নিয়মিত হোস্টেলের অন্য ছেলেদের র‌্যাগিং করে ‘দাদাগিরি ফি’ মানে তোলা আদায় করতে লাগল। ইদানিং তো কেল্টুর বাড়বাড়ন্ত হোস্টেল ছাড়িয়ে, গোটা সেক্টর ফাইভে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেলুনওয়ালা থেকে গরিব রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত তার হাত থেকে নিস্তার পেত না।

গতকাল সকালে হঠাৎ নাসিরের রুম থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে নন্টে আর ফন্টে দৌড়ে গিয়ে দেখে, কেল্টুদা জোর করে নাসিরের মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে নিচ্ছে। নাসির হোস্টেলে নতুন। মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে সে বাংলাদেশ থেকে এদেশে পড়তে এসেছে। একটু গো-বেচারা টাইপের ছেলে নাসির। তাই কেল্টু যখন তাকে চমকালো, তখন সে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। কেল্টু নাসিরের মানিব্যাগ থেকে কড়কড়ে একটা ৫০০টাকার নোট বার করে নিয়ে বললে, ‘দু’দিনের দুটো কার্লসবার্গ আর চাটের খরচ।’ তারপর নাসিরকে উদ্দেশ্য করে বললে, ‘সপ্তাহে ৫০০ করে সেলামি দিতে হবেআর হ্যাঁ, পরের বার আমি নিতে আসব না, আমার রুমে এসে দিয়ে যাবি।’

কেল্টু চলে যাবার পর নাসির তার বড়ো খালা মহসিনাকে ফোন করে সব বেত্তান্ত বললো। এমনকি কেল্টুর একটা ছবিও হোয়াটস্‌অ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। মহসিনা খালা প্রতিবেশী দেশের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ওপর খালার সাথে সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের আবার মধুর সম্পর্ক। তাই নাসিরের কাছ থেকে সবটা শুনে যখন মহসিনা বিবি সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবকে কেল্টুর নামে অভিযোগ করলেন, তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব পুলিশ ডাকলেন। যদিও কেল্টু যে হোস্টেলে তোলাবাজি করে, সে কথা নন্টে-ফন্টে আগে অনেকবার সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবকে বলেছে, কিন্তু তখন তিনি এসব কথা কানেই তোলেনি। তখন তো সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের নয়নের মণি ছিল কেল্টু। আর তোলার টাকায় প্রায়ই সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের জন্য নিত্যনতুন খাবার নিয়ে আসতো কেল্টু।

কেল্টুকে আজ যখন পুলিশ কলার ধরে প্রিজন ভ্যানে ভরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন হোস্টেলের সবাই তা দেখে নিজেদের মধ্যে গুজ্‌গুজ্‌ ফুস্‌ফুস্‌ করছিল। সুপারেনটেন্ডেন্ট স্যার তার রুমের বাইরে দাড়িয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘হতচ্ছাড়াটা বড় বেড়েছিল, এতদিনে বিদায় হলো।’ কিন্তু কেল্টুর ভবি ভোলবার নয়। প্রিজন ভ্যানে ঢোকার আগে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে নাসিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুলিশ আমাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না। জামাইবাবুকে ফোন করেছি, বলেছে থানায় ছেলে পাঠিয়ে ছাড়িয়ে আনবে। ফিরে এসে হিসাবের খাতাটা মিলিয়ে নেব। তৈরি থাকিস্‌।’

নন্টে আর ফন্টে হোস্টেলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। যখন প্রিজন ভ্যানটা গেট থেকে বের হচ্ছিল, তখন নন্টে কেল্টুদার দিকে তাকিয়ে ফন্টেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমাদের কেল্টুদা আজ ইন্টারন্যাশনাল তোলাবাজের স্বীকৃতি পেল।’

Thursday 7 July 2016

দাশুর দোলনা

দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেল, এমন সময় দেখি পাগলা দাশু, স্কুল থেকে দেওয়া নতুন জুতো পরে পিঠে সরকারি ব্যাগ ঝুলিয়ে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে ক্লাসে ঢুকছে। নবীনচাঁদ  বলল, ‘‘শুনেছিস? আমাদের স্কুলে দোলনা বসছে।’’ যেমন বলা, অমনি দাশরথি হঠাৎ হাত-পা ছেড়ে বইটই ফেলে খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের ওপর বসে পড়ল! পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিত হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না! দেখে আমরা তো অবাক!

পণ্ডিতমশায় ক্লাসে এসেছেন, তখনো পুরোদমে তার হাসি চলেছে। সবাই ভাবল, ‘‘ছোঁড়াটা খেপে গেল নাকি?’’ যা হোক, খানিকটা হুটোপুটির পর সে ঠান্ডা হয়ে, ব্যাগ থেকে ‘কথাঞ্জলি’ বার করে ফার্স্ট বেঞ্চের এক ধারে বসে পড়ল। পণ্ডিতমশায় বললেন, ‘‘ওরকম হাসছিলে কেন?’’ দাশু নবিনচাঁদকে দেখিয়ে বলল, ‘‘স্যার, নবীন বলল, আমাদের স্কুল নাকি এবারে সেন্ট্রাল পার্ক মডেলে তৈরী হবে!’’ পণ্ডিতমশায় তাকে বললেন, ‘‘তোমাকে না আজ স্কুলে আসতে নিষেধ করেছিলাম দাশু। আজ বোর্ড থেকে কয়েকজন আসবেন স্কুল ইনস্পেকশন করতে। কোনোরকম বদমায়েশি করবে না। তাহলে কিন্তু আমার চাকরি চলে যাবে।’’ দাশু খানিক মাথা চুলকে বলল, ‘‘আচ্ছা স্যার, যদি আপনার চাকরি চলে যায়, তাহলে কি আপনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কোটায় আবার চাকরি পাবেন?’’ পণ্ডিতমশায় খুব কড়ারকমের ধমক লাগিয়ে তাকে বললেন, ‘‘আর একবার যদি তুমি মুখ খোলো তাহলে চাব্‌কে লাল করে দেব। এখন যাও গিয়ে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বোসো।’’ কিন্তু পাগলার তাতেও লজ্জা নেই, সে ‘কথাঞ্জলি’ বইটা দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিক্‌ফিক্ করে হাসতে হাসতে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল।

কিছুক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর সদলবলে এসে পৌছোলেন। প্রথমেই আমাদের ক্লাসে ঢুকে ইনস্পেক্টর প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা বলতো, কোলকাতার কাছে গড়ে ওঠা একটা স্মার্ট সিটির নাম কি?’’ কেউ উত্তর দিতে পারছে না। এমন সময় দাশু পিছনের বেঞ্চ থেকে হাত তুলল। পন্ডিতমশাই দাশুর দিকে কট্‌মট্‌ করে তাকিয়ে হাত নামাতে ইশারা করলেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে! দাশু এবারে নিজে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘স্যার, ওটা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর তৈরী রাজারহাট।’’ ইনস্পেক্টর-‘‘ইয়েস! রাজারহাট, উত্তরটা সঠিক। তবে ওটা তো ওনার তৈরী নয়!’’ দাশু-‘‘না স্যার, ওটা উনিই তৈরি করেছেন। আর ইঁট বালি সিমেন্ট সব সব্যদা সাপ্লাই দিয়েছেন। জানেন স্যার! আমি শুনেছি, তাজমহল তৈরীর সময় শাহজাহানকেও সব্যদা মার্বেল সাপ্লাই দিয়েছিলেন।’’

দাশুর এক্সট্রা উত্তরে ইনস্পেক্টর একটু থমকে গেলেন, তারপর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা বলতো, একজন শিক্ষকের বেতন যদি প্রতি বছরে ১৪শতাংশ করে বাড়ে, তাহলে যে ব্যক্তির বেতন এখন ১৫হাজার টাকা তার বেতন পাঁচ বছর পরে কতো হবে?’’ আবার দাশু সবার আগেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে। পন্ডিতমশাই আবার তার দিকে কট্‌মট্‌ করে তাকিয়ে। অন্য কেউ পারছে না দেখে বাধ্য হয়ে ইনস্পেক্টর দাশুকে বলতে বললেন। দাশু বলল, ‘‘স্যার, এক টাকাও বাড়বে না। ওটা তো রাজ্য সরকারের আন্ডারে।’’

ইনস্পেক্টর এবারে পন্ডিতমশাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘আপনার এই ছাত্র তো দেখছি একেবারে রত্ন।’’ পন্ডিতমশাই বললেন, ‘‘স্যার, ওটা একটা গাধা! ওকে দিয়ে কিস্যু হবে না।’’ দাশু এবারে গম্ভীরভাবে বলল- ‘‘স্যার, আমি বড় হয়ে একদিন কিন্তু উপাচার্ষ হবো।’’ পন্ডিতমশাই রেগে গিয়ে বললেন, ‘‘ওরে ছাগল! উপাচার্ষ হতে গেলে কতো পড়াশুনা করতে হয় জানিস! পি এইচ ডি করতে হয়।’’ দাশু বলল, ‘‘স্যার, এখন আর ওসব পি এইচ ডি লাগে না! আর যদি বলেন একান্ত দরকার, তাহলে আমি অমন ডিগ্রি দুদিনেই বানিয়ে নিতে পারি। কোথাকার ডিগ্রি লাগবে বলুন না! ইস্ট জর্জিয়া, নাকি উত্তরবঙ্গ!’’

ইনস্পেক্টর এবারে নিজেই হেসে ফেললেন দাশুর উত্তর শুনে। তারপর বললেন, ‘‘আচ্ছা, তুমি এতো কিছু জানো, তোমার এতো জ্ঞান, তাহলে পিছনের বেঞ্চে বসো কেন?’’ দাশু এবারে ফিক্‌ করে হেসে বলল, ‘‘দাদা বলেছে পিছনের বেঞ্চে বসতে। কারণ ছুরিটা নাকি পিছন থেকেই আসে।’’


নবীন, কেষ্টা ও ক্লাসের বাকি বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল – ‘‘আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচ্‌কেমি করে?’’