Friday 2 June 2017

মহেশ

জৈষ্ঠ্যের দুপুরে মাটির ঘরের বারান্দায় বসে একহাতে তালপাতা দিয়ে বাতাস খাচ্ছিল আর অন‍্য হাতে গামছা দিয়ে ঘাম মুছছিল গফুর। উঠানে কিছু শুকনো চিবাচ্ছিল মহেশ। এমনসময় সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তর্করত্ন। গফুরকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে, 'গফুর বাড়ি আছো নাকি!' বলে হাঁক দিয়ে রাস্তা ছেড়ে গফুরের বাড়ির দিকে এগোলো...

- একি গফুর, তুমি মাতার আজকাল খেয়াল রাখছো না! গরমে নিজে হাওয়া খাচ্ছো আর মাতাকে হাওয়া দিচ্ছ না!

(গফুর তর্করত্নের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল)

- আমার মুখের দিকে না দেখে মাতার ডায়েটের দিকে লক্ষ্য দাও! এমন শুকনো খড় খাওয়ালে ২২ নয়, ১২ক‍্যারেটের সোনা পাবে চোনা তে!

(মহেশ একবার হাম্বা করে ডেকে উঠলো। তর্করত্ন ভাবলো মহেশ তার কথার সম্মতি জানালো।)

- (অবক হয়ে) মাতা কে? আমার আম্মা তো কবেই মারা গিয়েছে!

- ওরে গাধা মাতা মানে গো-মাতা! সেটাও জানিস না! আরে ৩৩কোটি দেবতা মিলেমিশে ককটেল হয়ে আছে তোর মহেশের মধ‍্যে। আর তুই কিনা ৩৩কোটি দেবতাকে মানে মহেশকে এই ভাবে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! যদি জমিদারের গো-রক্ষক বাহিনীর চোখে পড়ে তাহলে তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। যদি মাতা সানস্টোক হয়ে মারা যায় তাহলে তোর কি অবস্থা হবে জানিস!

- আজ্ঞে, সামনেই চাষের সিজন। মহেশ মারা গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।

- আরে মহেশ মারা যাওয়া মানে ৩৩কোটি দেবতা মারা যাওয়া। তুই শুধু চাষের কথা ভাবছিস! এই যে গরমে মাঠ ঘাট সব আগুন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তোর খড়ের ঘরের চালার তলাটা ঠান্ডা সেটা মহেশের জন‍্য!

- তাই নাকি?

- আরে মহেশই তো, সমস্ত কসমিক রে, তেজস্ক্রিয় আলো, সব নিজের শিং দিয়ে শোষণ করে নিচ্ছে। তোর মেয়ে প্রতিদিন ঘরের মাটির দেওয়ালে গোবর লেপে দেয় বলেই তো তোর ঘরটা এতো ঠান্ডা। এই যে তুই এতো বিড়ি খাস, তাও তোর ক‍্যানসার হয়নি। কারণ তুই রোজ দুধ খাস। আর গোমূত্র তো অমৃত! তুই এতদিনে যত পাপ করেছিস, এমনকি পূর্বজন্মের পাপও সব ধুয়ে যাবে গো-মূত্র খেলে।

- বলো কি পন্ডিত! যদি পেট খারাপ হয়!

- ধুর! পেট খারাপ, ওলাওঠা সব সেরে যাবে! প্রতিদিন সকালে এক চামচ করে গোবর খাবি। তাছাড়া এই যে মহেশ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা তোর বাড়িতে হাম্বা হাম্বা করে ঢাকছে, এতেই আশেপাশের সমস্ত জীবানু মরে যাবে। আরে মহেশ ঘরে আছে মানেই তোর ঘর আর ঘর নেই! জানবি ওটা নার্সিংহোম।

(মহেশ একবার শিং নাড়িয়ে হাম্বা করে ঢেকে উঠলো)

- (অবাক হয়ে) বলো কি পন্ডিত! মহেশের এতো গুণ!

- এই যে তুই মাঠে থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে বারান্দায় বসে বুক ভরে দম নিতে পারছিস, সেটাও মহেশের জন‍্য। মহেশই তো তোকে অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছে।

(ইস্কুল থেকে ফিরে আমিনা এতক্ষণ তর্করত্নের পিছনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো শুনছিল। এবারে আমিনা তর্করত্নের কথা ধরলো..)

- কেবলমাত্র গাছ অক্সিজেন দেয়। আর কিছু নিন্ম শ্রেণীর প্রাণী।

(তর্করন্ত পিছন ফিরে আমিনাকে দেখে)

- ইস্কুল থেকে ফিরলে বুঝি!

- বলছিলাম গরু কোনোদিন অক্সিজেন দিতে পারে না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

- (হাসি মুখে) আমার কোনো ভুল হয়নি! আসলে এসব তথ‍্য তোমাদের ইস্কুলের বিজ্ঞানের স‍্যারেরাও জানেন না! তাই তোমাদের শেখাতে পারেনি! আরে গো-মূত্র খেলে যে লিভার ভালো থাকে, শ্বেত রক্ত কনিকা লাফায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, দুধে কেরেটিন প্রোটিন থাকে, ভিটামিন-এ সংশ্লেষ হয়! এসব তথ‍্য ওনারা কিছুই জানেন না। আর গরুর এতো গুণ আছে বলেই না কদিন পরেই গরু আমাদের জাতীয় পশু হবে! সে খবর তুমি রাখো!

- জাতীয় পশু তো বাঘ। তা হঠাৎ বাঘকে সরিয়ে গরু কেন?

- বাঘেরা এখন সংখ‍্যালঘু। আর সংখ‍্যালঘুরা কোনোদিন দেশের প্রতীক হতে পারে!

- তাহলে তো ময়ূরকে সরিয়ে কাককে জাতীয় পাখি করা উচিত! ময়ূরের থেকে কাকের সংখ্যা তো অনেক বেশী। তাছাড়া কাককে জাতীয় পাখি করলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানটাও খানিকটা গতি পাবে!

- না না, ওটা হচ্ছে না! গরু জাতীয় পশু আর কাক জাতীয় পাখি হলে তো গেরুয়া সবুজ জোটটা সবাই বুঝতে পেরে যাবে! তাছাড়া ময়ূর
ওরা তো সঙ্গম করে না! ওরা ব্রম্ভচর্য পালন করে।

- তাহলে ময়ূরের বাচ্ছা হয় কি করে?

- ময়ূর বর্ষাকালে আকাশ ডাকলে ভয়ে কাঁদে, তখন ময়ূরী ছুটে আসে আর ময়ূরের চোখের জল খেয়ে নেয়। ওরা তো আর আমাদের মতন রুমাল দিয়ে মুছে দিতে পারে না। ময়ূরের সেই চোখের জল খেয়েই ময়ূরী গর্ভবতী হয়।

- মোটেই না। বাজে কথা। ওরা সঙ্গম করে।

- মেয়ের সাহস তো কম নয়! তক্করত্নের মুখের ওপর তক্ক করে! জানিস তুই, সাত গেরামের সবাই আমার কথা মান‍্যি করে!

- আমি স্কুলে আমার বন্ধুদের মোবাইলে ইউটিউবে দেখেছি ময়ূর ময়ূরী সঙ্গম করে।

- ঐ দ‍্যাখ গফুর, তোর মেয়ে আজকাল ইস্কুলে গিয়ে কিসব দেখছে! পই পই করে বলেছিলুম, মেয়েকে ইস্কুলে পাঠাস নে! এখন বুঝলি তো! আজ আমার বিরূদ্ধে কথা বলছে, কাল জমিদারের বিরুদ্ধে বলবে, পরশু দ‍্যাশের বিরুদ্ধে বলবে! তোর মেয়ে শীঘ্রই দেশদ্রোহী হয়ে যাবে! কথাটা মিলিয়ে নিস....

তর্করত্ন আমিনার কাছে যোগ‍্য জবাব পেয়ে নিজের লাইনে ফিরে গেল, মানে ঐ উঠান টপকে যে পথে এসেছিল সেই পথ দিয়ে ধুতি গুটিয়ে জোরে পা চালালো। মুখে তার একটাই কথা- মেয়ের মুখের কি ভাষা! রাম! রাম!

আমিনা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, রাম রাম নয়! জয় শ্রীরাম বলুন পন্ডিতমশাই!

(শরৎচন্দ্রের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী

No comments:

Post a Comment