Thursday 18 January 2018

রানীর অসুখ

রানীর ভারি অসুখ। সরকারি, বেসরকারি, সুপার স্পেশ‍্যালিটি, কোনো হাসপাতালের ডাক্তারই সারাতে পারলো না। অসুখটা যে কী তা কেউ বলতে পারে না, অসুখ সারাতেও পারে না। সারাবে কী করে? অসুখ তো আর সত্যিকারের নয়। রানীর কেবলই মনেহয়, আসেপাশের সবাই তার বিরুদ্ধে চক্কান্ত, ষড়যন্ত্র করছে। কত রকমের কত ওষুধ রানী খেয়ে দেখলেন, কিছুতেই কিছু হল না। আই ফোন কিনে দেওয়া হলো, হাওয়া বদলের জন‍্য সিঙ্গাপুর, লন্ডন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু রানীর মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি হ'ল না।

তখন রানী'মা গেলেন ক্ষেপে। তিনি বললেন, "চাবকে লাল করে দাও এই অপদার্থগুলোকে, পেছনে বাঁশ দিয়ে দাও।" এমনি করে চিকিৎসকেরা বিদায় হলেন। এমনকি রানীর পছন্দের চিকিৎসক, কুকুরের ডায়ালিসিস স্পেশালিস্টও ভয়ে আর কেউ রানীর বাড়ির দিকেও যায় না। তখন সকলের ভাবনা হ'ল, তাই তো, শেষটায় কী রানী প‍্যানিকেই মারা যাবেন?

এমন সময় নাগপুর থেকে এক হাফ প‍্যান্ট পরা সন্ন্যাসী এসে বলল, "অসুখ সারাবার উপায় আমি জানি, কিন্তু সে ভারি শক্ত। তোমরা কী সব করতে পারবে?" মন্ত্রী, কোটাল, সেনাপতি, পাত্রমিত্র সবাই বলল— "কেন পারব না? খুব পারব।" রানীর প্রিয় দামালরা বলল, "জান্‌ দিতে হয় জান্‌ দেব!" তখন সন্ন্যাসী বলল, "প্রথমে এমন এক লোক খুঁজে আন যিনি গোমাতার ভক্ত, যিনি সারাক্ষণ বন্ধুদের (মিত্রোঁ) মনের কথা শোনান (মন কি বাত), যে দাঙ্গা হোক বা কৃষক আত্মহত্যা, সব সময়ে, সব অবস্থাতেই খুশি থাকে।" সবাই বলল, "তারপর?" সন্ন্যাসী বলল, "তারপর সেই লোকের হাতে বানানো চা যদি রানীকে খাওয়ানো যায়, তাহলেই সব অসুখ সেরে উঠবে।"

তাড়াতাড়ি রানী মার কাছে খবর গেল। তিনি শুনে বললেন, "আরে, এই সহজ উপায়টা থাকতে এতদিন সবাই মিলে করছিল কী? যাও, এখনি খোঁজ করে সেই চা-ওয়ালা লোকটার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এস। জয়, মামা-টিমা-নুষ এর জয়"

চারিদিকে লোক ছুটল, রাজ্যময় 'খোঁজ-খোঁজ' রব পড়ে গেল, অলিতে গলিতে পাড়ার মোড়ে হাইওয়ের পাশে সব জায়গায় রানীর কাতিলানা হাসি মুখের ছবি দিয়ে পোস্টার টাঙানো হলো, কিন্তু সে লোকের আর সন্ধান পাওয়া যায় না। যে যায় সেই ফিরে আসে আর বলে, " কই, তেমন লোকের তো দেখা পাওয়া গেল না!" সবার মুখে এই একই কথা। তখন মন্ত্রীমশাই রেগে বললেন, "এদের দিয়ে কী কোন কাজ হয়? এ মূর্খেরা খুঁজতেই জানে না।" এই বলে তিনি নিজেই বেরোলেন সে অজানা লোকের খোঁজ করতে।

বিহারে গিয়ে তিনি দেখলেন, এক বুড়ো লোক প্রচুর গরুদের চারা খাওয়াচ্ছেন। মন্ত্রী ভাবলেন বাঃ এই লোকটাকে তো বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে, ওর তো অনেক ছেলেপুলে, টাকা পয়সাও আছে দেখছি। তাছাড়া এতো গরুকে ভালোবাসে। এর হাতের চা খেলেই রানী নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবেন। মন্ত্রীমশাই এর রকম ভাবছেন, ঠিক এই সময়েই পুলিশ এসে তাকে জেলে ধরে নিয়ে গেল। আশপাশের লোকজনদের জিঞ্জেস করে জানা গেল, লোকটা গরুদের খাবার নাকি নিজেই খেয়ে নিয়েছে। ব্যাপার দেখে মন্ত্রীমশাই মাথা নেড়ে সেখান থেকে সরে পড়লেন।

তারপর তিনি খোঁজ করতে দিল্লি চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে রামলীলা ময়দানে দেখলেন এক বৃদ্ধ লোক শুয়ে আছে আর তাকে ঘিরে প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে। কাছে গিয়ে তিনি জানলেন বৃদ্ধটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে অনশন করছেন। বৃদ্ধকে সমস্ত কথা খুলে বললেন মন্ত্রী। বৃদ্ধ বললেন, আমি তো অতো দূর যাওয়ার ধকল সইতে পারবো না! মন্ত্রী ভাবলো এতো আরেক সমস্যা, জোর করে নিয়ে গেলে যদি পথেই পটল তোলে! রানীকে খবর দেওয়া হলো। সব শুনে রানী নিজেই দ‍্যাখা করতে দিল্লি রওনা দিলেন। অবাক কান্ড, রানী দিল্লি পৌঁছে রামলীলা ময়দানে বসে আছে কিন্তু সেই বৃদ্ধর আর কোনো পাত্তা নেই! রানী বেজায় চটে গেছেন।

কিছুদিন পরে আবার রামলীলা ময়দানে ভিড় জমেছে দেখে মন্ত্রী ভাবলেন বৃদ্ধ বুঝি ফিরে এসেছে। অনেক আশা নিয়ে গিয়ে দেখলেন, সেই বৃদ্ধ নয়, এক অন‍্য গেরুয়া পোশাক পরা সাধু নাচানাচি করছে ওখানে। লোকটার মাথাভরা চুল, মুখভরা দাড়ি, সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ঠিক অস্কার পুরষ্কারের ট্রফির মতন অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ছেন মাঝেমধ্যেই। তার সামনে রাখা আছে চাল ডাল সাবান শ‍্যাম্পু থেকে নুডুলস। মন্ত্রী দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ইনি কি সাধু! নাকি মুদি দোকানদার! মন্ত্রী সেই বাবাকে সব কথা খুলে বলল। সব শুনে বাবা বললো, আমার পরিচিত এমন এক লোক আছে, তবে তাকে পাওয়া মুসকিল। আসলে তিনি কখন কোন দেশে থাকে বোঝা মুসকিল! আমি বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্রী ঠিকানা নিয়ে প্রনাম করে উঠতে যাবে তখন বাবা তাকে তার বেশকিছু প্রোডাক্ট প‍্যাকেট দিয়ে বলল, এগুলো রানীর জন‍্য, একেবারে স্বদেশী।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, মন্ত্রী সেই বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। কানাঘুষো শুনতে পায় লোকটা নাকি সার্জিক্যাল স্টাইক করে বিদেশে পালিয়েছে। অবশেষে ছমাস পর দেখা মিলল। ছাপান্ন ইন্চি ছাতি, গায়ে ১০লাখ টাকার কোট, মুখে রানীর মতন শিশুসুলভ হাসি। মন্ত্রী বিনয়ের সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি যোদ্ধা? তিনি হেসে বলেন, আমি চৌকিদার। মন্ত্রী তারপর রানীর অসুখের কথা তাকে বলতে তিনি বললেন, আমি থাকতে রানীর কোনো ভয় নেই। এই নিন দুটো লাড্ডু, এদুটো রানীর দুহাতে দিয়ে দেবেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রানীকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসুন। দেরি করবেন না, আমাকে আবার জন্মদিনের কেক কাটতে বিদেশে চলে যেতে হবে।

রানীকে সব কথা খুলে বলতে, রানী তার বাড়িতে চা খেতে যেতে রাজি হয়ে গেল। যদিও প্রথমে একটু ইতস্তত করছিলেন। তারপর দুজনে একান্তে বন্ধ ঘরে চা খেতে খেতে কথা শুরু করলেন। ঘন্টা তিনেক পর যখন দুজনে ঘর থেকে বার হলেন, তখন দুজনের মুখেই হাসি। একজন 'বিকাশ' বলে চিৎকার করছেন তো অন‍্যজন 'উন্নয়ন' বলে চিৎকার করছেন। মন্ত্রী পারিষদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রানীকে এতো খুশি আগে কোনোদিন কেউ দেখেনি। শেষে রানীর সাথে উনি একটা সেলফি তুলে টুইট করলেনে। রানী ফেরার পথে সেটা রিটুইট করতে ভুললেন না।

(পুরোটাই কাল্পনিক গল্প)

Friday 12 January 2018

পাগলা দাশু

আজ অভিকে হাসিমুখে লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুলে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক! কেষ্টা, নবিনচাঁদ ছুট্টে গেলো অভির কাছে। কেষ্টা জিঞ্জেস করলো, ভাই আজ এতো খুশির রহস্যটা কি? নবিনচাঁদ জিজ্ঞেস করলো, বিশ্ব বাংলার বলটা পিসি কি তোকে দিয়ে দিলো নাকি! অভি কেবল হাসতে লাগলো। দাশু একমনে বেঞ্চিতে ঘসে ঘসে কি একটা লিখছিলো। জগবন্ধু এসে দাশুকে বললো, ব‍্যাপারটা কিরে দাশু, অভি এতো লাফালাফি করছে কেন? দাশু বললো, অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই ওর মাথাটা গেছে। মাঝেমধ্যেই গরম হয়ে যায়, তখন এমন লাফালাফি করে। জগবন্ধু বললো, তবে যে ডাক্তার বললো অভি পুরো সুস্থ। দাশু হেসে বলল, ওরম মনে হয়!

অভি ক্লাসে ঢুকতেই জগবন্ধু অভির মাথায় একমগ জল ঢেলে দিলো। শীতেকালে এমনিতেই অভি সপ্তাহে একদিন স্নান করে। তাও গরম জলে। নেহাত তখন পাশে কেষ্টা আর নবিনচাঁদ ছিল, নাহলে জগবন্ধুর জগত ছাড়া হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারতো না। দুজনে মিলে অভিকে জাপটে ধরে রাখে। অভি চেঁচাতে থাকে, হারামজাদাটাকে আজ মেরেই ফেলবো! জগবন্ধু কাঁচুমাচু হয়ে বলতে লাগলো, দাশুই তো আমাকে বললো অভির মাথা মাঝেমধ্যে গরম হয়ে যায়! তাই আমি...। মিনিট দশেক বাদে অভি শান্ত হতে কেষ্টা জিঞ্জেস করলো, কি গুরু কেসটা কি বললে না তো! অভি বুক ফুলিয়ে বললো, আজ আমার পিসি ডক্টর হয়ে গেলো! নবিনচাঁদ উত্তেজিত হয়ে বললো করলো, নিশ্চয়ই হার্ট স্পেশালিস্ট! অভি ঘাড় নেড়ে না বললো। জগবন্ধু বললো, তাহলে ডেন্টিস্ট। পাড়ার মোড়ে পিসির ইয়া বড়ো দাঁত বার করা ছবি টাঙিয়েছে দেখেছি। কেষ্টা জগবন্ধুর দিকে কটমট করে তাকাতেই জগা চুপ হয়ে গেল। শেষে অভিই বলল, আরে এটা ঐ ডাক্তার নয় ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হয়েছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পিসির 'পোতিভার' সম্মান জানিয়ে এটা দিয়েছে। দাশু এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল, এবারে সে ফোড়ন কাটলো, তা পিসি কবে ইস্ট জর্জিয়ার উপাধিটা রিটার্ন করলো? অভি দাশুর কথার উত্তর না দিয়েই পিসির গুণকীর্তন করতে লাগলো। পিসি সমাজ সেবা করে, গান করে, কবিতা লেখে। দাশু আবার বলল, এপাং ওপাং ঝপাং। অভি উপেক্ষা করে বলেই চললো, পিসি পাহাড় জঙ্গল নিয়ে লেখা বই, গীতাঞ্জলি কথাঞ্জলী নানান বই আছে, পিসি দারুণ ছবিও আঁকে। দাশু আবার ফোড়ন কাটলো, এখন আর আঁকে না, খরিদ্দার এখন জেলে। এবারে অভির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। রেগে গিয়ে অভি দাশুকে বলতে লাগলো, আমার পিসির পিছনে লাগলে তোমার পিছনে অ্যাটম বোমা ফাটিয়ে দেব। এটা শুনেই নবিনচাঁদ বলল, তোর পিসির অ্যাটমবোমা বিষ্ফোরণের ছবিটা দারুণ।

এমন সময় প্রধানশিক্ষক বিষ্টুবাবু ক্লাসে প্রবেশ করলেন। ঝগড়া বন্ধ করে যে যার জায়গায় চুপচাপ বসে পড়লো। তোমাদের জন‍্য একটা সুখবর আছে। এবার থেকে প্রতিবছর যারা পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হবে তাদের স্কলারশিপ দেওয়ার হবে। জগবন্ধু, স‍্যারের প্রিয় ছাত্র। তাই দিকে তাকিয়ে বিষ্টুবাবু বললেন, জগবন্ধু মেডেল হাতছাড়া করলে চলবে না! কেষ্টা বললো, স‍্যার হঠাৎ করে এই স্কলারশিপ কি উপলক্ষে চালু হলো? বিষ্টুবাবু বললেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষামন্ত্রীর স্ত্রী গত হয়েছেন, তাই তার স্মরণে এটা উনি চালু করলেন। জগবন্ধু হাতের গাঁট গুনছে দেখে বিষ্টুবাবু জিঞ্জেস করলেন, কি হিসাব করছো? জগবন্ধু আফসোসের সুরে বলল, তিনটে বছর প্রথম হওয়া বৃথা হয়ে গেলো! যদি বছর খানেক আগে এটা চালু হতো...। বিষ্টুবাবু জিভ কেটে বললেন, ছিঃ ছিঃ অমন বলতে নেই! পিছনের বেঞ্চে বসে কেষ্টা আর দাশু ফিসফিস করে কথা বলছিল। বিষ্টুবাবুর চোখ যেতেই উনি কেষ্টাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি আলোচনা চলছে শুনি! তোমাদের তো এ জন্মেআর স্কলারশিপ পাওয়ার আশা দেখছি না! কেষ্ট বলল, স‍্যার খাদ‍্যমন্ত্রীর স্ত্রী মারা গেলে কি স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক প‍্যাকেট করে মিহিদানার প‍্যাকেট দেওয়া হবে? বিষ্টুবাবুর বেতের লাঠি কেষ্টার পিঠে পড়তেই কেষ্টা কাঁদতে কাঁদতে বলল, স‍্যার দাশু আমাকে বলেছে।

বিষ্টুবাবু ক্লাস থেকে বের হতে যাবেন এমন সময় নবিনচাঁদ বলল, স‍্যার আগামীকাল কি স্কুল ছুটি থাকবে? বিষ্টুবাবু রেগে গিয়ে বললেন, কোন দুঃখে! পড়াশোনার নাম নেই, কেবল ছুটি! নবিনচাঁদ ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, না মানে দাশু বলছিল অভির পিসি ডক্টর হয়েছে সেইজন‍্য আগামীকাল স্কুল অফিস কাছারি সব ছুটি থাকবে। স‍্যার যখন নবিনচাঁদকে ধমকাচ্ছিল তখন দাশু পিছনের বেঞ্চে বসে মিচকে মিচকে হাসছিল।

আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না কেবল মিচ্‌‌কেমি করে ?