Tuesday 10 May 2016

‘জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’

পঁচিশে বৈশাখ একেবারে সাতসকালে ধপ্‌ধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে লালমোহনবাবু হাজির। কথা অবিশ্যি গতকালই হয়েছিল যে সেদিন সকালে জোড়াসাঁকো যাওয়া হবে। প্রস্তাবটা লালমোহনবাবুই দিয়েছিলেন, ফেলুদাও এককথায় রাজি হয়ে যায়।

গাড়িতে বসে ফেলুদা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? পঁচিশে বৈশাখের দিন হঠাৎ জোড়াসাঁকো যাওয়ার ইচ্ছে জাগলো কেন? আমি যতদূর চিনি তাতে আপনাকে তো ঠিক রবীন্দ্রভক্ত আখ্যা দেওয়া চলে না!

ঢুলুঢুলু চোখে একটু হেসে লালমোহনবাবু বললেন, ‘জোড়াসাঁকোর পটভূমিকায় একটা নতুন গল্পের প্লট মাথায় এসেছে, তাই জায়গাটার ডিটেলটা একটু সার্ভে করা দরকার।’’

এবার আমাদের দু’জনেরই চোখ কপালে উঠে গেল।

‘‘বলেন কি মশাই? জোড়াসাঁকোতে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস উইথ প্রখর রুদ্র!’’

‘‘ইয়েস স্যার, জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’’

‘‘ব্যাপারটা কিন্তু একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। জোড়াসাঁকো নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাঙালীর আবেগদ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ—কে নেই তার মধ্যে? সেই জোড়াসাঁকোয় আপনার জোড়াপিশাচকে এনে ফেলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? বাঙালীর আবেগ ধরে এরকম টানাটানি কিন্তু হজম হবে না!’’

‘‘দেখুন মশাই, আমার গপ্প জোড়াসাঁকোকে নিয়ে, ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে তো তাতে কিছু থাকছে না, তাহলে অসুবিধেটা কোথায়? টু বি ভেরি অনেস্ট, আমি জোড়াসাঁকোটা দেখতেই ওখানে যাচ্ছি।’’

এইবার ফেলুদা সোজা হয়ে বসে বললো, ‘‘কিন্তু জোড়াসাঁকো এলাকায় ‘জোড়াসাঁকো’টা যে ঠিক কোথায় ছিল সেটা এখন আর জানা যায় না। সম্ভবত ওটা রবীন্দ্রনাথেরও জন্মের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই সেক্ষেত্রে আপনার সার্ভে মাঠে মারা যেতে বাধ্য।’’

এইবার জটায়ুর ঠোঁটে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দেখা দিল, যেটাকে লামা স্মাইলবললেও ভুল হয় না। ‘‘ফেলুবাবু, জোড়া কথাটার দু’রকম মানে হয় জানেন তো? একটা হল জোড়া মানে ডবল, আর অন্যটা হল যুক্ত।’’

‘‘এ তো আমারই কথা আমাকে ফেরত দিচ্ছেন মশাই!’’ ফেলুদা অবাক।

‘‘হ্যাঁ, ঠিক তেমনই জোড়াসাঁকো কথাটারও দু’রকম মানে হয়। এক হল আপনার রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো, আর আমি বলছি জোড়াতালি দেওয়া সাঁকো-র কথা যেটা এই সেদিন ভেঙ্গে পড়ল। ওই জোড়াতালি দেওয়া সাঁকোটাই সার্ভে করতে যাচ্ছি মশায়ওই সাঁকো ভেঙে পড়ার চক্রান্ত নিয়েই তো ‘জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’ নামে আমার নতুন রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। ফ্লাইওভার মানে তো একরকম সাঁকোই, কি বলেন মশাই?’’

‘‘সে না হয় জোড়া সাঁকোটা বোঝা গেলো, কিন্তু আপনার ওই ‘জোড়াপিশাচ’-টা তো ঠিক বুঝলাম না?’’ ফেলুদা গাড়ি থেকে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো।

লালমোহনবাবুও গাড়ি থেকে নেমেই একটা আস্ত পান মুখে নিয়ে কচর-মচর করতে করতে বললেন, ‘‘আরে বুঝলেন না মশাই! ওই খুড়ো-ভাইপোই তো যত নষ্টের মূল! পচা মাল দিয়ে সাঁকোর গোড়া এমন পচিয়ে দিয়েছে যে এতগুলো লোক মারা গেলো! অবিশ্যি ওদের ওপরে একটা মামদো, আর তারও ওপরে একটা শাকচুন্নি আছে। কিন্তু আমার গোয়েন্দা প্রখর রুদ্রকে অত উঁচুতে তুলছি না। আপাতত জোড়া পিশাচেই হয়ে যাবে।’’

জটায়ু একটু থেমে মুচকি হেসে আবার বললেন, ‘‘কি মশাই, বলুন, কেমন প্লট নামিয়েছি? জমবে না?’’

ফেলুদা সিগারেটটা ফস্‌ করে জ্বালিয়ে একগাল ধোঁয়া টেনে বললো, ‘‘জমবে আবার না! জমে একেবারে ক্ষীর! কি বল তোপ্‌সে!‌’’

(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)

1 comment: