বেজায় গরম। ফুটপাতে ত্রিফলার
নিচে অল্প ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, ঘেমে অস্থির। ত্রিফলা বাতিস্তম্ভে এখন নীল-সাদা টিউব জড়িয়ে দেওয়ায় গরম আরো
বেড়ে গেছে। নীল-সাদা লোহার রেলিং-এর পাশেই আমার হাওয়াই চটিজোড়া রাখা ছিল। আকাশের
দিকে তাকিয়ে আপন খেয়ালে যেই না আমি বললাম, ‘‘এবছরে মনে হয়
কালবৈশাখী আর ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ করবে না!’’
অমনি হাওয়াই চটি বললো, ‘কুৎসা!’
কি আপদ! চটিটা আবার কুৎসা বলে কেন?
চেয়ে দেখি আমার হাওয়াই চটিটা আর
চটি নেই,
দিব্যি একটা ময়না পাখি হয়ে গেছে! প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে
বলছে, ‘‘আমি কালীঘাটের ময়না!’’
আমি বললাম, ‘‘কি মুশকিল! ছিল হাওয়াই চটি, হয়ে গেল একটা ময়না।’’
অমনি ময়না বলে উঠল, ‘‘মুশকিল আবার কি? ছিল ত্রিফলা, হয়ে গেলো ‘জ-ফলা’, ছিল
ঘুষ, হয়ে গেল দিব্যি অনুদান। এ তো হামেশাই হচ্ছে।’’
আমি খানিক ভেবে বললাম, ‘‘তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের
ময়না নও, আসলে তুমি হচ্ছো হাওয়াই চটি।’’
ময়না বলল, ‘‘ময়না বলতে পার, সারদাও বলতে পার, নারদাও বলতে পার।’’
আমি বললাম, ‘‘আবার সারদা-নারদা কোথা থেকে এলো?’’
শুনে ময়না, ‘‘তাও জানো না?’’ বলে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্ফ্যাঁচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি
অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হলো, ঠিকই তো, ঐ সারদা-নারদা কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা
উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ‘‘ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ,
বুঝতে পেরেছি।’’
ময়নাটা খুশি হয়ে বললো, ‘‘হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে - সারদার স, জালিয়াত-এর ত, ক্ষমতার তা- হলো ‘সততা’। কেমন, হল তো?’’
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে ময়নাটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর ময়নাটা খানিকক্ষণ
আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, ‘‘গরম লাগে তো এই লন্ডনে কেন,
সুইজারল্যান্ডেই গেলেই পার। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চাপলেই তো রামপুরহাটের মামাবাড়ি
হয়ে সোজা রাস্তা।’’
আমি বললাম, ‘‘বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?
ওখানকার আবহাওয়া নাকি এখন মোটেই ভালো নয়! আকাশ নাকি প্রায়ই ‘গুরুং
গুরুং’ করে ডাকে, ‘হড়কা’ বানের ভয়ও আছে।’’
ময়না বলল, ‘‘যত সব কুৎসা। দিব্যি সুইজারল্যান্ড হাসছে।’’
আমি বললাম, ‘‘কি করে যেতে হয় তুমি জানো?’’
ময়না একগাল হেসে বলল, ‘‘তা আর জানি নে? বললাম তো একবার! লিখে নাও—কালীঘাট,
পার্ক স্ট্রীট, কাকদ্বীপ, কামদুনি, কাটোয়া, লাভপুর,
বারাসাত, রানাঘাট, সুইজারল্যান্ড, ব্যাস্!
সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হলো।’’
আমি বললাম, ‘‘তা হলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পারো?’’
শুনে ময়নাটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে
গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ‘‘উঁহু, সে আমার
কর্ম নয়। আমার মোদো-মাতাল ভাইটা যদি থাকতো, তা হলে সে ঠিকঠাক
বাতলাতে পারতো।’’
আমি বললাম, ‘‘সেটা আবার কে? থাকে কোথায়?’’
ময়না বলল, ‘‘মাতালের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।’’
আমি বললাম, ‘‘কোথায় গেলে তার সাথে দেখা হবে?’’
ময়না খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘‘উহুঁ, সেটি হচ্ছে না বাপু, সেটি হবার জো নেই।’’
আমি বললাম, ‘‘সে আবার কি রকম?’’
ময়না বলল, ‘‘সে কিরকম তুমি জানো? মনে করো, তুমি যখন যাবে কামারহাটিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন
তিনি থাকবেন মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে। যদি মিডল্যান্ড পার্কে যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন চাঁদনির কোনো বারে। আবার সেখানে গেলে দেখবে
নারায়নপুরে সিদ্ধা পাইনের ফ্ল্যাটে গেছেন। ওখানে গিয়ে শুনবে তিনি আছেন
আলিপুরের জেলে। আলিপুরে যদি যাও, খোঁজ করে জানবে সে উডবার্ণে
আছে। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই। এসব দেখেই তো কবি লিখেছিল, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য
কোথা, অন্য কোনোখানে।’’
আমি বললাম, ‘‘তা হলে তোমরা কি করে দেখা করো?’’
ময়না বলল, ‘‘সে অনেক হাঙ্গামা। আগে বিন্দু বিন্দু করে হিসেব কষে দেখতে হবে, ভাই কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে,
ভাই কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর দেখতে হবে,
ভাই এখন কোথায় আছে। তারপর দেখতে হবে, সেই
হিসেব মতো তুমি যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছোবে, তখন ভাই কোথায়
থাকবে। তারপর দেখতে হবে কার সাথে কি অবস্থায় থাকবে, তারপর
দেখতে হবে জলের ঘোরে ‘অন’ হয়ে আছে কিনা! ‘অফ’ হলেই তবে দেখা মিলবে।’’
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ‘‘সে কিরকম হিসেব? এ তো বড়ই জটিল লাগছে!’’
ময়না বলল, ‘‘হুঁ হুঁ বাবা, সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?’’
এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের
উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ‘‘এই মনে করো মাতালভাই।’’ বলেই খানিকক্ষণ
গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইলো।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড়
কেটে বললো, ‘‘এই মনে করো পিয়ালীর ফ্ল্যাট’’—বলে আবার ঘাড় বেঁকিয়ে
চুপ করে রইলো।
তার পর হঠাৎ আবার একটা আঁচড়
কেটে বললো, ‘‘এই তিন আঁচড় দিয়ে দিলাম, এবারে
১কোটি ৮৬লক্ষ টাকা দাও।’’
এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার
কেমন যেন রাগ ধরে গেলো। আমি বললাম, ‘‘দূর ছাই! কি সব আবোল
তাবোল বকছো, একটুও ভালো লাগছে না।’’
ময়না বলল, ‘‘আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোঁজ,
আমি যা বলবো, মন দিয়ে শোনো।’’ আমি চোখ বুঁজলাম।
ময়না বলতে শুরু করলো- ‘‘মাতাল
ভাইটা চোলাই খেয়ে খেয়ে নিজের বাঁশ নিজেই নিয়েছে। প্রায়ই এখন এস এস কে এম ছুটতে হয়।
কদিন নজরবন্দি করে রেখেও লাভ হয়নি। অ্যালকোহল আর ওর ওপর ‘প্রভাবশালী’ নয়। আগে সকাল
সন্ধ্যা মিউজিক সিস্টেমে হরিনাম শুনতো। এখন আবার ভোজপুরি শোনার সখ জেগেছে। তবে
ইদানীং ভাই আমার প্রায় নাকি ‘ঐশ্বরিক দুঃস্বপ্ন’ দেখছে, হার্মাদরা নাকি আবার ‘দুষ্টগ্রহ’-র দুঃস্বপ্নেও তাকে তাড়া করে ফিরছে..।’’
এই বলে ময়নাটা সেই যে চুপ করে গেলো, তারপর আর কোনো কথাই নেই।
চোখ বুঁজেই আছি, বুঁজেই আছি, অনেকক্ষণ হয়ে গেলো ময়নাটার আর কোনো
সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি ময়নাটা
গাছের ডালে বসে একটা ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা হনুমানের সাথে সেলফি তুলছে। কান পাততে
শুনতে পেলুম ফিস্ফিস্ করে ডিগ্রি নিয়ে কিসব আলোচনা করছে!
************
No comments:
Post a Comment