পথিক = না! একটু
জল না পেলে আর চলছে না! সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু ‘চড়াম্
চড়াম্’ করছে। কিন্তু জল চাই কার কাছে? দুপুর রোদে গেরস্ত
বাড়ির দরজা এঁটে এসি চালিয়ে সব ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ হয়ে ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। বেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন ‘চাব্কে লাল’ করে দেবে।
পথেও ত লোকজন দেখছিনে।‒ ঐ তো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে একজন
আসছে! দেখি, ওনাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।....
পথিক =
মশাই,
একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা = জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? উনি তো এখনও ‘জলপাই উৎসব’ শুরুই
করেনি। আলুর চপ, তেলেভাজা চান তো অঢেল দিতে পারি—
পথিক = না
না,
এই গরমে ওসব আমি খাবো না‒
ঝুড়িওয়ালা = না, আলুর চপের কথা তো আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই
চাচ্ছিলেন কিনা, তা তো আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম আর কি‒
পথিক = না হে, আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒
ঝুড়িওয়ালা =
চাচ্ছেন না তো ‘কোথায় পাব’, ‘কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম ‘অপপ্রচার’
করবার মানে কি?
পথিক = আপনি
ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒
ঝুড়িওয়ালা = জল
চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়‒ ‘জলপাই’ বলবার দরকার কি? জল আর
জলপাই কি এক হল? ‘কথাঞ্জলি’ আর ‘গীতাঞ্জলি’ কি একই বই?
‘ঘুষ’কে কি আপনি ‘অনুদান’ বলেন? চাল কিনতে এসে
চালতার খোঁজ করেন?
পথিক = ঘাট
হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে। দরকার হয় আমাকে দুটো চড়
মারুন, কিন্তু আর আমার মাথা খাবেন না প্লিজ।
(ঝুড়িওয়ালার প্রস্থান)
পথিক =
দেখলে! একটা ‘ছোট্টো ঘটনাকে’ কি বানিয়ে ফেললে! যাক্, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি।
(লাঠি হাতে, হাওয়াই চটি পায়ে চাদর গায়ে
এক বৃদ্ধের প্রবেশ)
বৃদ্ধ = কে ও? ‘লোহাচোর’ নাকি?
পথিক =
আজ্ঞে না,
আমি ‘সোহ্রাব’ নই। আমি কালীঘাটের লোক‒ একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম‒
বৃদ্ধ = বলো
কি হে?
কালীঘাট ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতি? ‒ হাঃ, হাঃ, হাঃ। ওখানে তো
শুনেছি উনি জল ধরছেন, আর কলসীতে ভরছেন। লোকজনকেও বলছেন ‘জল ধরো, জল ভরো’।
পথিক = ধুর
মশাই,
ওসব প্রলাপের কথা ছাড়ুন তো! সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায়
তেষ্টা পেয়ে গেছে।
বৃদ্ধ = তা
তো পাবেই। ভালো জল যদি হয়, তাঁর ‘অনুপ্রেরণায়’ সবারই তেষ্টা পায়।
তেমন জল তো ৩৪ বছরেও খাওনি! বলি বোলপুরের কেষ্টার দেওয়া ‘গুড়জল’ খেয়েছো কোনোদিন?
পথিক =
আজ্ঞে না,
তা খাইনি-
বৃদ্ধ =
খাওনি?
অ্যাঃ! বোলপুর হচ্ছে ‘কবিগুড়ি’র জায়গা। কত দেশের জল খেলাম‒সিঙ্গাপুরের
জল,
লন্ডনের জল ‒ কিন্তু বোলপুরের কেষ্টার
গুড়জল, আহা, অমনটি আর কোথাও খেলাম না!
পথিক = তা
মশাই, আপনার গুড়জল আপনি মাথায় করে রাখুন। আপাতত
এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে‒
বৃদ্ধ = তাহলে বাপু কালীঘাটে
বসেই ওখানকার খালের জল খেলেই তো পারতে? আমাদের জল পছন্দ না হয়,
খেও না—ব্যস্। তোমায় কে এত সাধাসাধি করেছে! গায়েপড়ে কুচুটের মতন ‘কুৎসা’
করবার দরকারটা কি ছিল? আমাদের জল তোমার কি এমন বাঁশ দিয়েছে
শুনি!
(রাগে গজগজ করিতে করিতে
বৃদ্ধের প্রস্থান। পাশের এক
বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হাসিমুখ প্রকাশিত হইলো।)
বৃদ্ধ = কি হে? এত বাঁশ দেওয়া-দেয়ি কিসের?
পথিক = আজ্ঞে না, বাঁশ দেওয়া নয়। আমি জল
চাইছিলুম,
তা উনি সে কথা কানেই নিলেন না-কেবলই উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে
লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম তো রেগেমেগে অস্থির!
বৃদ্ধ = আরে, দূর দূর! তুমিও
যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি? ও ‘বেচারা’ উন্নয়নের
জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি? ওর যে
ভাই আছে, মাঝেমধ্যে কুইজ-টুইজ করে, সেটাও
ত একটা গাধা। ফোটোশপটাও ঠিকমতো করতে পারে না।
পথিক = কি জানি মশাই! জলের কথা
বলতেই দেশ-বিদেশের জল, বলে পাঁচরকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ = হুঁম! ভাবলে বুঝি খুব
বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকামতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি ২৯৪টা বলে দেব-
পথিক = আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আমি
বলছিলুম কি একটু খাবার জল‒
বৃদ্ধ = কি বলছো? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, শুনে যাও। চিট ফান্ডের
প্রতারিতদের চোখের জল, টেট দিয়ে চাকরি না পাওয়া বেকারদের
চোখের জল, বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের চোখের জল, রানুর মায়ের চোখের জল, এছাড়া মদনের পাগলা জল,
‘ত্রিফলা’র জল, এমনকি বাথরুমে জমে থাকা দু’-মগ
জল, গোনোনি বুঝি?
পথিক = না মশাই, গুনিনি। আমার অন্য অনেক কাজ আছে।
বৃদ্ধ = সে কি! কাজের কথা উঠছে
কেন? আমরা তো সে কবেই আমাদের ১০০শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছি। ৪বছরের মধ্যে ৪০০বছরের
কাজ করে দিয়েছি! তুমি তো দেখছি বড্ড কুঁড়ে!
(সশব্দে বৃদ্ধের জানলাটি বন্ধ হইয়া গেলো)
পথিক = নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও অন্তত পুকুরটুকুর দেখতে পাই কি না।
(লম্বা লম্বা চুল, চোখে নীল-সাদা চশমা,
হাতে অ্যাপেলের আই-ফোন, পায়ে অজন্তা’র হাওয়াই
চটি, একজন মহিলার প্রবেশ)
পথিক = দেখি, এই মহিলা নেহাৎ
এসে পড়েছে যখন, ওনাকেই একটু জিজ্ঞাসা করি বরং। ম্যাডাম, আমি অনেক দূর
থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ম্যাডাম = কি বলছেন? ‘জল’ মিলবে না? খুব মিলবে। একশোবার মিলবে! দাঁড়ান,
এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒চারিদিকে যখন উন্নয়নের জোয়ারের জল, হঠাৎ এলো স্টিং কল, চাপে পড়লো দল, বিরোধীরা জোট করে ভেঙে দিল মনোবল, জেলেতে এখনও বন্দি
আমার ছাগল, জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি? আর কত চান?
পথিক = (স্বগতোক্তি) এ দেখি আরেক
পাগল! (জোরে) ম্যাডাম, আমি সে রকম মেলাবার কথা বলিনি।
ম্যাডাম = তবে কি রকম মিল
চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, বাংলা, ইংরাজী না হলে হিন্দি বা উর্দুতে শুনবেন? অলচিকিতে চলবে? আরে জলের
নামকরণের উপর তো মশাই আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলেছি।
পথিক = (স্বগতোক্তি) ভালো বিপদেই
পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) ম্যাডাম! আর কিছু চাইনে, (আরো জোরে) শুধু একটু জল খেতে চাই!
ম্যাডাম = ও, বুঝেছি।
শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই। এই তো? আচ্ছা বেশ। এ আর মিলবে না কেন?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই‒১৪৪ এর চাপে প্রাণ আই-ঢাই। একটা ছাপ্পা
দেওয়ারও উপায় নাই! বিরোধী-কমিশন মাসতুতো ভাই! আমি সমস্ত রেকর্ড রাখছি তাই, কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে গেলে তোমাদের কে বাঁচাবে ভাই! কেমন? ঠিক মিলেছে তো?
পথিক = আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার।
ম্যাডাম = এই, এই ছেলে যাচ্ছো কোথায়? আমার বাকি কবিতাগুলো শুনে
যাও...
[বি:দ্র: এই প্রসঙ্গে
জেনে রাখা ভালো, ম্যাডামের কবিতা পড়ে এক কবিতাপ্রেমী খোলা চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন:
‘‘দোহাই, আপনি হাতে মারুন, ভাতে মারুন, নবান্নের ছাতে মারুন, আলো নিভিয়ে মারুন, আলো জ্বালিয়ে মারুন, সিঙ্গুর করুন, ঝোলাগুড় করুন, শ্রীকান্ত করুন, ইন্দ্রনাথ করুন, ইংরেজির গুষ্টি করুন, সিঙ্গাপুরি চোষান, মর্তমান চোষান, ঘরে ছেলে ঢোকান, উঠোনে মেয়ে ঢোকান, বাদশাকে লুঙ্গি ডান্স করান, পাগলুকে থোড়া রোমান্স
করান – সব ঝেলে নেব, মাইরি – শুধু কবিতাটা বন্ধ রাখুন, প্লিজ। ওই কবিতা পড়ে
কবিতার বাবা কাল গায়ে দড়ি দিয়ে গলায় আগুন লাগিয়েছে।’’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।]
(শেষাংশ সংগৃহীত)
*********
Fantastic !
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteA perfect usage of current political verbiages..excellent!!😊
ReplyDeleteGood. Yet scope For improvement.
ReplyDeleteHilarious....
ReplyDeleteIpshita chakraborty
ReplyDelete(Y)
Rabindra moreni.... Perfectly crafted.
ReplyDeleteদিদি ক্য়ালাবে
ReplyDelete