Friday, 29 April 2016

পেরেকের ফোটোশপ


স্কুলে গরমের ছুটি পড়তেই ফেলুদা বললো, ‘‘চল তোপ্‌সে, অনেকদিন পাহাড়ে যাওয়া হয়নি। কদিন পাহাড়ে ঘুরে আসি।’’ বাবাও আপত্তি না করে বললো, ‘‘ভালোই তো! এই গরমে কোলকাতায় বসে বসে পচার কোন মানেই হয় না! তার চেয়ে বরং তোরা কদিন দার্জিলিং ঘুরে আয়।’’ ফেলুদা হেসে বললো, ‘‘সুইজারল্যান্ড ইজ ফার বেটার দ্যান লন্ডন।’’ আমি বললাম, ‘‘এর মধ্যে আবার সুইজারল্যান্ড-লন্ডন কোত্থেকে এলো!’’ আমার কথা শুনে বাবা আর ফেলুদা দু’জনেই হেসে উঠলেন। ফেলুদা বললো, ‘‘তুই লালমোহনবাবুকে এখুনি হোয়াটস্‌অ্যাপ্‌ করে দে, আজ রাতেই ১০.০৫-এ দার্জিলিং মেল। সময়মতন সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যেন শিয়ালদহ স্টেশনে চলে আসেন।’’

আমি আর ফেলুদা শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছি, রাত ৯.৪৫ নাগাদ দেখি লালমোহনবাবু একহাতে সুটকেশ, আর কাঁধে তাঁর প্রিয় ঝোলাটা নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে আসছেন। আমাদের কাছে এসেই সুটকেশটা রেখে তার ওপরেই বসে পড়লেন। ঝোলা থেকে জলের বোতলটা বার করে, ঢক ঢক করে পুরোটা শেষ করে ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘মশাই, কুলিগুলোকে কত করে বললাম সুটকেশটা নিতে, কেউ নিলো না! আমি দশ টাকা বেশি দেব বললাম, তাতে বলে কিনা, আমরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না!’’ ফেলুদা বললো, ‘‘চিন্তা করবেন না, মাননীয়া বলেছেন কিছুদিনের মধ্যেই ‘নো রিফিউজাল কুলি’ চালু হবে। চলুন এখন ট্রেনে ওঠা যাক।’’

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন নামলাম তখন সকাল ৭.৩০। দুটো কচুরি আর ল্যাংচা সহযোগে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জিপ এন.এইচ. ৩১এ ধরে সেবকের দিকে ছুটে চললো। এতক্ষণ লালমোহনবাবু জানালা দিয়ে তিস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন; সেবক ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন, ‘‘মিত্তিরমশাই! এখানকার সব লোকের মুখেই দেখছি হাসি লেগে আছে! হেসে হেসে লোকেরা বাজার-হাট করছে, হেসে হেসে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, এমনকি চা-শ্রমিকরাও হাসছে!’’ ব্যাপারটা আমিও অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করেছি। ফেলুদা পকেট থেকে একটা চারমিনার ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললো, ‘‘এটা আর নতুন কি! ২০১১-পর থেকেই তো পাহাড় হাসছে।’’

দার্জিলিং পৌঁছে হোটেল ঠিক পেতে আবার সমস্যা। যে হোটেলেই যাচ্ছি সবার একই শর্ত, তাদের হোটেলে থাকলে তাদের রেস্টুরেন্টেই খেতে হবে, তাদের গাড়ি নিয়েই সাইট-সিইং-এ যেতে হবে। লালমোহনবাবু রেগেমেগে ম্যানেজারকে বলেই ফেললেন, ‘‘ইউ মেক দার্জিলিং অ্যাজ নিউটাউন-রাজারহাট! সিন্ডিকেটরাজ! আই উইল কমপ্লেন ম্যাডাম। দেয়ার আর সো মেনি সব্যসাচী ইন ইওর সুইজারল্যান্ড।’’ ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন। তারপর ম্যানেজারের কাছে থেকে চাবি নিয়ে রুমে গেলেন।

লালমোহনবাবুর ডাকে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফেলুদা দেখি টিভিতে আইপিএল দেখছে। ম্যালের দিকে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বললো, ‘‘ম্যাচটা জমে গেছে। তোরা ঘুরে আয়, আমি কাল যাবো।’’ অগত্যা আমি আর লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লুম ম্যালের উদ্দেশ্যে। এটা সেটা নানান দোকান ঘুরে রকমারি জিনিসপত্র দেখছি। হঠাৎ আমার নজর পড়লো একটা দোকানের দিকে। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘পেরেক কিউরিও শপ।’ আমি লালমোহনবাবুকে দোকানটা দেখাতেই উনি লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘‘এই দোকানটাই তো খুঁজছিলাম।’’ 

দোকানের ভিতরে ঢুকে দেখি কোঁকড়ানো চুলের, মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ফোনে কাকে বলেই চলেছেন, ‘‘কুৎসা, কুৎসা, কুৎসা, কুৎসা....।’’ আমাদের দেখে ফোনটা রেখে বললেন, ‘‘বলুন, কি ছবি লাগবে! আমার কাছে প্রচুর দুর্মূল্য ও প্রাচীন সব পোট্রেট পাবেন।’’ এই বলেই ভদ্রলোক একটার পর একটা ছবি দেখাতে লাগলেন। রাকেশ রোশনের চাঁদে যাওয়ার ছবি, রবীন্দ্রনাথের গান্ধীজীকে ফলের রস খাওয়ানোর ছবি, রামমোহন বিধানসভায় সতীদাহ আইন পাশ করার দাবিতে বক্তব্য রাখছেন তার ছবি, সিধো ও কান্‌হো-র সাথে ডহরবাবুও যে সেলফি তুলছেন তার ছবি। আমি তো অবাক হয়ে হাঁ করে সব দেখছি। লালমোহনবাবুর কিন্তু তাতেও মন ভরছে না। অবশেষে ভদ্রলোক আলমারির ভিতর থেকে একটি ছবি বার করে বললেন, ‘‘এটা আমার বেস্ট কালেকশন।’’ ছবিটা দেখে তো আমি হাঁ! বি জে পি-র নেতা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সি পি আই (এম)-র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন! একেবারে তাজ্জব কি বাত্‌! লালমোহনবাবু বেশ চড়া দামে ছবিটি কিনেও ফেললেন! একেবারে দোকানদারের মু মাঙ্গি কীমত্‌!

বাড়ি ফিরে লালমোহনবাবু তো রীতিমত গর্বের সঙ্গে ফেলুদাকে ছবিটা দেখালেন। কিন্তু ফেলুদা লালমোহনবাবুর কেনা ছবিটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘‘গাঙ্গুলিবাবু, এটা তো আসল ছবি নয়। এটা ফোটোশপ্‌ করা হয়েছে।’’ লালমোহনবাবুর চোখ একেবারে কপালে উঠে গেলো, ‘‘বলেন কি মিত্তির মশাই! আমার এত্তগুলো টাকা জলে গেলো! ব্যাটা আমাকে ঠকালো!’’ ফেলুদা বললো, ‘‘চিন্তা করবেন না লালমোহন বাবু, আপনি কাল সকালেই টাকা ফেরত পেয়ে যাবেন।’’ ফেলুদার কাছ থেকে আশ্বস্ত হয়ে লালমোহনবাবু ঘুমোতে গেলেন। আমিও শুয়ে পড়লুম। ফেলুদা তখনও তাঁর ল্যাপ্‌টপে কাজ করেই চলেছেন।

পরের দিন সকালে ফেলুদা আমাকে আর লালমোহনবাবুকে নিয়ে চললেন, ‘পেরেক কিউরিও শপ’-এর উদ্দেশ্যে। দোকানে ঢুকতেই গতকালের সেই ভদ্রলোক কম্পিউটারে কি সব কাজ করছেন। আমাদের দেখে উনি তাড়াতাড়ি উঠে এলেন। ফেলুদা বললেন, ‘‘আচ্ছা, আপনার কাছে কি ঐ ছবিটা আছে যেটাতে মমতাজ বেগম মোদীজীকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন?’’ ভদ্রলোক ফেলুদাকে একবার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘‘ধুস্‌! এমন ছবি আমি জন্মেও দেখিনি!’’ ফেলুদা পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। আমরা সবাই অবাক! দেখি সত্যিই ছবিতে মমতাজ বেগম মোদীজীকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন! ফেলুদা দোকানদারকে বললেন, ‘‘ফোটোশপ আমরাও জানি। এখুনি টাকাটা ফেরত দাও।’’ দোকানদার অবস্থা বেগতিক দেখে কোনো কথা না বলে সুড়সুড় করে লালমোহনবাবুকে সব টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।


চলে আসার সময় ফেলুদা দোকানদারকে বললেন, ‘‘আপনার পেছনে তিন আঁচড়ে আঁকা ১কোটি ৮৬লক্ষ টাকা দামের যে ছবিটি দেওয়ালে টাঙানো আছে সেটাও জাল। অরিজিনালটা সুদীপ্তর বাড়িতে আছে।’’

No comments:

Post a Comment