সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরছি, এমন সময় রাস্তার
পাশে বাঁশবাগানের ভিতর থেকে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে মনে হলো; যেন কেউ হাসতে হাসতে আর
কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না। উঁকি মেরে দেখি একটা জন্তু-হেলে না এঁড়ে, পান্ডা না গিরগিটি, হনু না ভাল্লুক, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না-খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর
বলছে, ‘এই দিলো দিলো, নারদ হুল ফুটিয়ে
দিলো।’
হঠাৎ আমায় দেখে সে একটু দম পেয়ে
উঠে বলল, ‘ভাগ্যিস্, তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই
হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাচ্ছিলো।’
আমি বললাম, ‘তুমি এমন
সাংঘাতিক রকম হাসছো কেন?’
জন্তুটা বলল, ‘হাসছি কেন
শুনবে? কলকাতা যদি লন্ডন হতো, মেয়র
তাহলে কোট-প্যান্ট পরতো, চাদর নিশ্চয়ই সঙ্গে রাখতো না। তাহলে
অতগুলো ঘুষের টাকা কি করে ঢাকা দিতো? হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ!!’ এই বলে সে আবার হাসতে
হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আমি বললাম, ‘কি আশ্চর্য! এর জন্য
তুমি এতো ভয়ানক হাসছ?’
সে হাসি থামিয়ে বলল, ‘না না, শুধু এর
জন্য নয়। মনে করো একটা ডাক্তার তাঁর এক পেশেন্টকে ডায়ালিসিস করাতে গিয়ে, তাঁর কুকুরের ডায়ালিসিস করে দিলো! হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ হা!’- আবার সেই বেদম হাসির পালা!
আমি বললাম, ‘কেন তুমি এই সব
অসম্ভব কথা ভেবে খামোকা হেসে কষ্ট পাচ্ছো?’
সে বলল, ‘না না না না না, সব কি আর অসম্ভব?
মনে করো, একদিন দুটো পুলিশ একটা গাড়ি করে টেটের প্রশ্ন নিয়ে যাচ্ছিল,
হঠাৎ প্রশ্নগুলি লাফ দিয়ে জানালার বাইরে বেরিয়ে গেল, রাস্তার পাশেই একটা ছাগল ছিল, সে সব প্রশ্ন খেয়ে
নিল। হোঃ হোঃ হোঃ।’
জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি
অদ্ভুত লাগলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে? তোমার
নাম কি?’ সে খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘আমার
নাম হিজিবিজ্বিজ্। আমার ভায়ের নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার
ভাইপোর নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার ভাইঝির নাম হিজিবিজ্বিজ্..।’
আমি বললাম, ‘তার চেয়ে সোজা বললেই তো হয় যে তোমার গুষ্টিশুদ্ধ
সবাই হিজিবিজ্বিজ্ ।’
সে আবার খানিক ভেবে বললো, ‘তা তো নয়,
আমার বাবার নাম পরিবর্তন। আমার খুড়োর নাম পরিবর্তন, আমার মেসোর নাম পরিবর্তন, আমার দিদির নাম পরিবর্তন..।’
আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘সত্যি বলছ?
না, বানিয়ে?’ জন্তুটা
কেমন যেন থতমত খেয়ে বললো, ‘না না না না, আমার দিদির নাম সততা।’ আমার ভয়ানক রাগ হলো, তেড়ে
বললাম, ‘না, তোমার একটা কথাও বিশ্বাস
করি না।’
অমনি কথা নেই, বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে
একটা ছাগল হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার নামে কুৎসা
রটানো হচ্ছে বুঝি ?’
আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘না’, কিন্তু
কিছু বলার আগেই সে তড়বড় করে বলে যেতে লাগলো, ‘তা তোমরা যতই কুৎসা রটাও, চক্রান্ত করো, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না।
তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে- ‘ছাগলে কি
না খায়।’
এই বলে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে
বক্তৃতা আরম্ভ করল: ‘হে, মা-মাটি-মানুষ এবং স্নেহের হিজিবিজ্বিজ্, আমার গলায়
ঝুলানো ইস্ট জর্জিয়ার ডক্টরেট সার্টিফিকেটটা দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম
শ্রীমতি ব্যাকরণ শিল, DA, খাদ্যসাথী বিশারদ। এই চোপ! চোপ! কেউ কোনো কথা বলবে
না। আমি কি বলছি সবাই শোনো। আমি খুব চমৎকার ‘ব্যা’ করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ। আর শিল তো যেখানেই যাই, সঙ্গে নিয়ে যাই। সুযোগ
পেলেই ইঞ্চি মেপে পুঁতে দিয়ে আসি। ইংরিজিতে লিখবার সময় লিখি DA, যেটা সর্বদা বকেয়াই থাকে। কোন্ কোন্ জিনিস খাওয়া যায়,
আর কোন্টা কোন্টা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে নবান্নে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যসাথীবিশারদ।’
একদমে নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যাকরণ
শিল আবার শুরু করলো, ‘তোমরা যে বলো, সোনালী কি না বলে, ছাগলে কি না খায়—এটা
ভারী অন্যায়। এই তো একটু আগে ঐ হতভাগাটা বলছিল যে ছাগল টেটের প্রশ্ন খায়। এটা
এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা আমি
স্বীকার করছি যে ছাগলে তেলেভাজা মুড়ি, ল্যাংচা, লাড্ডু, এমনকি ঝালমুড়ির ঠোঙা পর্যন্ত খায়। আমার ভাইপো তো একবার ভরা জনসভায়
সপাটে গালে খেয়েছিল। আজকাল শিক্ষিত ছাগল, খেলোয়াড় ছাগল,
ডাক্তার ছাগলও ভগবানের (নারদ) প্রসাদ খেয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে
দু-একজন আবার ইঁট, বালি, সিমেন্ট খেতে ভালো বাসে। তবে সবাই নয়! এটাকে নেহাত ‘ছোট্ট
ঘটনা’ বলতে পার। আমার ছোটভাই মদন তো বিন্দু বিন্দু করে গোটা সিন্ধুই খেয়ে ফেলেছিল’-
বলেই ব্যাকরণ শিল আকাশের দিকে চোখ তুলে ব্যা ব্যা করে ভয়ানক কাঁদতে
লাগলো।
তাতে বুঝতে পারলাম যে ভাইটি শহীদ
হয়েছে। হিজিবিজ্বিজ্টা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ ছাগলটার বিকট কান্না শুনে সে
হাঁউ-মাঁউ করে ধড়মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির! আমি ভাবলাম বোকাটা মরে
বুঝি এবার! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা
ছুঁড়ে ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে হাসতে লেগেছে।
আমি বললাম, ‘এর মধ্যে আবার
হাসবার কি হল?’ সে বলল, ‘সেই একজন লোক
ছিল, সে সবসময়ই ‘অন’ হয়ে থাকতো, তার
পর-নারীর সাথে সম্পর্ক ছিলো। একদিন এক দালাল টাকা খেয়ে তার সব কেচ্ছা সবাইকে বলে
দিয়েছে-হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—।’
এমন বেমক্কা হাসির মধ্যে হঠাৎ
মনে হলো কেউ যেন আমাকে টানছে। ঘোর কেটে যেতে দেখলাম, আমি সন্ধ্যাবেলাতেই বারান্দার
চাটাইতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর সেই সুযোগে পাশের বাড়ির রামু গোয়ালার ছাগলটা ঢুকে আমার
চাদরটা চিবোতে আরম্ভ করেছে। আমিও এরকম উটকো স্বপ্নের কথা ভেবে হাসতে শুরু করলাম,
‘সত্যিই! ছাগলে কি না খায়!’
(সুকুমার রায়ের হিজিবিজ্বিজ্ ও
রামছাগল অবলম্বনে)
No comments:
Post a Comment