Thursday 12 May 2016

হ য ব র ল — ছিল হাওয়াই চটি, হয়ে গেল ময়না



বেজায় গরম। ফুটপাতে ত্রিফলার নিচে অল্প  ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, ঘেমে অস্থির। ত্রিফলা বাতিস্তম্ভে এখন নীল-সাদা টিউব জড়িয়ে দেওয়ায় গরম আরো বেড়ে গেছে। নীল-সাদা লোহার রেলিং-এর পাশেই আমার হাওয়াই চটিজোড়া রাখা ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন খেয়ালে যেই না আমি বললাম, ‘‘এবছরে মনে হয় কালবৈশাখী আর ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ করবে না!’’ 

অমনি হাওয়াই চটি বললো, ‘কুৎসা!’ কি আপদ! চটিটা আবার কুৎসা বলে কেন?

চেয়ে দেখি আমার হাওয়াই চটিটা আর চটি নেই, দিব্যি একটা ময়না পাখি হয়ে গেছে! প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘‘আমি কালীঘাটের ময়না!’’

আমি বললাম, ‘‘কি মুশকিল! ছিল হাওয়াই চটি, হয়ে গেল একটা ময়না।’’

অমনি ময়না বলে উঠল, ‘‘মুশকিল আবার কি? ছিল ত্রিফলা, হয়ে গেলো ‘জ-ফলা’, ছিল ঘুষ, হয়ে গেল দিব্যি অনুদান। এ তো হামেশাই হচ্ছে।’’

আমি খানিক ভেবে বললাম, ‘‘তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের ময়না নও, আসলে তুমি হচ্ছো হাওয়াই চটি।’’

ময়না বলল, ‘‘ময়না বলতে পার, সারদাও বলতে পার, নারদাও বলতে পার।’’

আমি বললাম, ‘‘আবার সারদা-নারদা কোথা থেকে এলো?’’

শুনে ময়না, ‘‘তাও জানো না?’’ বলে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্‌ফ্যাঁচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হলো, ঠিকই তো, ঐ সারদা-নারদা কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ‘‘ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।’’

ময়নাটা খুশি হয়ে বললো, ‘‘হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে - সারদার স, জালিয়াত-এর ত, ক্ষমতার তা- হলো ‘সততা’কেমন, হল তো?’’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে ময়নাটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর ময়নাটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, ‘‘গরম লাগে তো এই লন্ডনে কেন, সুইজারল্যান্ডেই গেলেই পার। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চাপলেই তো রামপুরহাটের মামাবাড়ি হয়ে সোজা রাস্তা।’’

আমি বললাম, ‘‘বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না? ওখানকার আবহাওয়া নাকি এখন মোটেই ভালো নয়! আকাশ নাকি প্রায়ই ‘গুরুং গুরুং’ করে ডাকে, ‘হড়কা’ বানের ভয়ও আছে।’’

ময়না বলল, ‘‘যত সব কুৎসা। দিব্যি সুইজারল্যান্ড হাসছে।’’

আমি বললাম, ‘‘কি করে যেতে হয় তুমি জানো?’’

ময়না একগাল হেসে বলল, ‘‘তা আর জানি নে? বললাম তো একবার! লিখে নাও—কালীঘাট, পার্ক স্ট্রীট, কাকদ্বীপ, কামদুনি, কাটোয়া, লাভপুর, বারাসাতরানাঘাট, সুইজারল্যান্ড, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হলো।’’

আমি বললাম, ‘‘তা হলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পারো?’’

শুনে ময়নাটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ‘‘উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার মোদো-মাতাল ভাইটা যদি থাকতো, তা হলে সে ঠিকঠাক বাতলাতে পারতো।’’

আমি বললাম, ‘‘সেটা আবার কে? থাকে কোথায়?’’

ময়না বলল, ‘‘মাতালের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।’’

আমি বললাম, ‘‘কোথায় গেলে তার সাথে দেখা হবে?’’

ময়না খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘‘উহুঁ, সেটি হচ্ছে না বাপু, সেটি হবার জো নেই।’’

আমি বললাম, ‘‘সে আবার কি রকম?’’

ময়না বলল, ‘‘সে কিরকম তুমি জানো? মনে করো, তুমি যখন যাবে কামারহাটিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে। যদি মিডল্যান্ড পার্কে যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন চাঁদনির কোনো বারে। আবার সেখানে গেলে দেখবে নারায়নপুরে সিদ্ধা পাইনের ফ্ল্যাটে গেছেন। ওখানে গিয়ে শুনবে তিনি আছেন আলিপুরের জেলে। আলিপুরে যদি যাও, খোঁজ করে জানবে সে উডবার্ণে আছে। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই। এসব দেখেই তো কবি লিখেছিল, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।’’

আমি বললাম, ‘‘তা হলে তোমরা কি করে দেখা করো?’’

ময়না বলল, ‘‘সে অনেক হাঙ্গামা। আগে বিন্দু বিন্দু করে হিসেব কষে দেখতে হবে, ভাই কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, ভাই কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর দেখতে হবে, ভাই এখন কোথায় আছে। তারপর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো তুমি যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছোবে, তখন ভাই কোথায় থাকবে। তারপর দেখতে হবে কার সাথে কি অবস্থায় থাকবে, তারপর দেখতে হবে জলের ঘোরে ‘অন’ হয়ে আছে কিনা! ‘অফ’ হলেই তবে দেখা মিলবে।’’

আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ‘‘সে কিরকম হিসেব? এ তো বড়ই জটিল লাগছে!’’

ময়না বলল, ‘‘হুঁ হুঁ বাবা, সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?’’

এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ‘‘এই মনে করো মাতালভাই।’’ বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইলো।

তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বললো, ‘‘এই মনে করো পিয়ালীর ফ্ল্যাট’’—বলে আবার ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে রইলো।

তার পর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বললো, ‘‘এই তিন আঁচড় দিয়ে দিলাম, এবারে ১কোটি ৮৬লক্ষ টাকা দাও।’’

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন যেন রাগ ধরে গেলো। আমি বললাম, ‘‘দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছো, একটুও ভালো লাগছে না।’’

ময়না বলল, ‘‘আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোঁজ, আমি যা বলবো, মন দিয়ে শোনো।’’ আমি চোখ বুঁজলাম।

ময়না বলতে শুরু করলো- ‘‘মাতাল ভাইটা চোলাই খেয়ে খেয়ে নিজের বাঁশ নিজেই নিয়েছে। প্রায়ই এখন এস এস কে এম ছুটতে হয়। কদিন নজরবন্দি করে রেখেও লাভ হয়নি। অ্যালকোহল আর ওর ওপর ‘প্রভাবশালী’ নয়। আগে সকাল সন্ধ্যা মিউজিক সিস্টেমে হরিনাম শুনতো। এখন আবার ভোজপুরি শোনার সখ জেগেছে। তবে ইদানীং ভাই আমার প্রায় নাকি ‘ঐশ্বরিক দুঃস্বপ্ন’ দেখছে, হার্মাদরা নাকি আবার ‘দুষ্টগ্রহ’-র দুঃস্বপ্নেও তাকে তাড়া করে ফিরছে..।’’ 

এই বলে ময়নাটা সেই যে চুপ করে গেলো, তারপর আর কোনো কথাই নেই।

চোখ বুঁজেই আছি, বুঁজেই আছি, অনেকক্ষণ হয়ে গেলো ময়নাটার আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি ময়নাটা গাছের ডালে বসে একটা ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা হনুমানের সাথে সেলফি তুলছে। কান পাততে শুনতে পেলুম ফিস্‌ফিস্‌ করে ডিগ্রি নিয়ে কিসব আলোচনা করছে!


************

Tuesday 10 May 2016

‘জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’

পঁচিশে বৈশাখ একেবারে সাতসকালে ধপ্‌ধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে লালমোহনবাবু হাজির। কথা অবিশ্যি গতকালই হয়েছিল যে সেদিন সকালে জোড়াসাঁকো যাওয়া হবে। প্রস্তাবটা লালমোহনবাবুই দিয়েছিলেন, ফেলুদাও এককথায় রাজি হয়ে যায়।

গাড়িতে বসে ফেলুদা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? পঁচিশে বৈশাখের দিন হঠাৎ জোড়াসাঁকো যাওয়ার ইচ্ছে জাগলো কেন? আমি যতদূর চিনি তাতে আপনাকে তো ঠিক রবীন্দ্রভক্ত আখ্যা দেওয়া চলে না!

ঢুলুঢুলু চোখে একটু হেসে লালমোহনবাবু বললেন, ‘জোড়াসাঁকোর পটভূমিকায় একটা নতুন গল্পের প্লট মাথায় এসেছে, তাই জায়গাটার ডিটেলটা একটু সার্ভে করা দরকার।’’

এবার আমাদের দু’জনেরই চোখ কপালে উঠে গেল।

‘‘বলেন কি মশাই? জোড়াসাঁকোতে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস উইথ প্রখর রুদ্র!’’

‘‘ইয়েস স্যার, জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’’

‘‘ব্যাপারটা কিন্তু একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। জোড়াসাঁকো নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাঙালীর আবেগদ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ—কে নেই তার মধ্যে? সেই জোড়াসাঁকোয় আপনার জোড়াপিশাচকে এনে ফেলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? বাঙালীর আবেগ ধরে এরকম টানাটানি কিন্তু হজম হবে না!’’

‘‘দেখুন মশাই, আমার গপ্প জোড়াসাঁকোকে নিয়ে, ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে তো তাতে কিছু থাকছে না, তাহলে অসুবিধেটা কোথায়? টু বি ভেরি অনেস্ট, আমি জোড়াসাঁকোটা দেখতেই ওখানে যাচ্ছি।’’

এইবার ফেলুদা সোজা হয়ে বসে বললো, ‘‘কিন্তু জোড়াসাঁকো এলাকায় ‘জোড়াসাঁকো’টা যে ঠিক কোথায় ছিল সেটা এখন আর জানা যায় না। সম্ভবত ওটা রবীন্দ্রনাথেরও জন্মের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই সেক্ষেত্রে আপনার সার্ভে মাঠে মারা যেতে বাধ্য।’’

এইবার জটায়ুর ঠোঁটে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দেখা দিল, যেটাকে লামা স্মাইলবললেও ভুল হয় না। ‘‘ফেলুবাবু, জোড়া কথাটার দু’রকম মানে হয় জানেন তো? একটা হল জোড়া মানে ডবল, আর অন্যটা হল যুক্ত।’’

‘‘এ তো আমারই কথা আমাকে ফেরত দিচ্ছেন মশাই!’’ ফেলুদা অবাক।

‘‘হ্যাঁ, ঠিক তেমনই জোড়াসাঁকো কথাটারও দু’রকম মানে হয়। এক হল আপনার রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো, আর আমি বলছি জোড়াতালি দেওয়া সাঁকো-র কথা যেটা এই সেদিন ভেঙ্গে পড়ল। ওই জোড়াতালি দেওয়া সাঁকোটাই সার্ভে করতে যাচ্ছি মশায়ওই সাঁকো ভেঙে পড়ার চক্রান্ত নিয়েই তো ‘জোড়াসাঁকোর জোড়াপিশাচ’ নামে আমার নতুন রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। ফ্লাইওভার মানে তো একরকম সাঁকোই, কি বলেন মশাই?’’

‘‘সে না হয় জোড়া সাঁকোটা বোঝা গেলো, কিন্তু আপনার ওই ‘জোড়াপিশাচ’-টা তো ঠিক বুঝলাম না?’’ ফেলুদা গাড়ি থেকে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো।

লালমোহনবাবুও গাড়ি থেকে নেমেই একটা আস্ত পান মুখে নিয়ে কচর-মচর করতে করতে বললেন, ‘‘আরে বুঝলেন না মশাই! ওই খুড়ো-ভাইপোই তো যত নষ্টের মূল! পচা মাল দিয়ে সাঁকোর গোড়া এমন পচিয়ে দিয়েছে যে এতগুলো লোক মারা গেলো! অবিশ্যি ওদের ওপরে একটা মামদো, আর তারও ওপরে একটা শাকচুন্নি আছে। কিন্তু আমার গোয়েন্দা প্রখর রুদ্রকে অত উঁচুতে তুলছি না। আপাতত জোড়া পিশাচেই হয়ে যাবে।’’

জটায়ু একটু থেমে মুচকি হেসে আবার বললেন, ‘‘কি মশাই, বলুন, কেমন প্লট নামিয়েছি? জমবে না?’’

ফেলুদা সিগারেটটা ফস্‌ করে জ্বালিয়ে একগাল ধোঁয়া টেনে বললো, ‘‘জমবে আবার না! জমে একেবারে ক্ষীর! কি বল তোপ্‌সে!‌’’

(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)

Sunday 8 May 2016

‘রবীন্দ্র মরেনি’

এ্যাই, এ্যাই, চোপ্‌! চোপ্‌! কোনো কথা নয়! আমি কি বলছি সবাই মন দিয়ে শোনো। আজ ২৫শে বৈশাখ, ‘কবিগুড়ি’-র জন্মদিন। সমস্ত কাগজে আমার গরমেন্ট থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। উনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তবে ওনার অভাব আমাদের নাটাবাড়ির রবি অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছেন। এই তো সামনেই বসে আছে আমাদের রবি। রবি একটু দাঁড়িয়ে হাতটা নেড়ে দাও।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলুম, ওনার সাথে আমার প্রথম আলাপ হয় কোলকাতা বইমেলায় ‘ভাগো বাংলা’-র স্টলে। উনি আমার লেখা ‘আমার জঙ্গল’, ‘আমার পাহাড়’, ‘আমার দামাল’, ‘সিন্ডিকেট সুবিধা’, ‘আমরা সবাই চোর’, ‘আজব ত্রিফলা’, ‘কলঙ্কিত সারদা’ ইত্যাদি বইগুলি খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। তখনই ওনার সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি বললেন, ‘‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক।’’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘কথাঞ্জলি’-র একটা কপি ওনাকে আমার অটোগ্রাফ দিয়ে গিফ্‌ট করি। পরে উনি ‘কথাঞ্জলি’-র অনুপ্রেরণায় ‘গীতাঞ্জলি’ নামে একটা বই লেখেন। ওই কয়েকটা গান-টান আর কি!

তো একদিন বিকেলে হঠাৎ উনি আমার বাড়িতে চলে এলেন। আবদার করে বললেন, ‘কথাঞ্জলি’-র মতন ‘গীতাঞ্জলি’-র ও ইংরেজি অনুবাদটা করে দিতে হবে। বয়স্ক মানুষের অনুরোধ তো আর ফেলতে পারি না। অগত্যা বাধ্য হয়ে করে দিলাম। নোবেল প্রাইজও পেয়ে গেলেন। অবশ্য পরে দেখা করে এর জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। নোবেল নেওয়ার জন্য যখন লন্ডনে যাওয়ার কথা বললেন, আমিই সব ব্যবস্থা করে দিলাম। ওখানে শেক্সপীয়ার আর কীটস্‌-এর সঙ্গে সিটিং করার অ্যাপোটা আমিই করে দিয়েছিলাম। আর কেউই সেটা পারছিল না। যাইহোক এসব ‘ছোট্ট ঘটনা’।  

ঝর্না দেখে উনি ‘মুক্তধারা’ লিখেছিলেন সেকথা তোমাদের আগেই বলেছি। আজ আরও একটা গোপন কথা বলছি। উনি ‘সোনার তরী’ কবিতাটি, পুরীতে আমার হোটেলে বসেই লেখেন।

এই এই কে কথা বলছে! আমি কি বলছি শোনো! গান্ধীজি যখন অনশন করেন তখন উনি নিজের হাতে গান্ধীজিকে ফলের রস খাইয়ে অনশন ভাঙান। তখনই তো উনি লিখেছিলেন, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো।’

আমি যখন সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় অনশন করি তখন উনি এসে আমাকে চকলেট খাইয়ে যেতেন। গরমের সময় যখন উনি বোলপুরে থাকতেন, শরীর ‘ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল কুল’ রাখতে প্রতিদিন অনুব্রতর ‘গুড় জল’ খেতেন।

৩৪ বছর ধরে উনি বাংলায় কোনো সম্মান পাননি। তাই ‘পরিবর্তন’-এর পরে আমি ওনাকে ট্র্যাফিক সিগন্যাল পোস্টে ঝুলিয়ে দিয়েছি। যাতে বাংলার মানুষ হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ওনাকে স্মরণ করতে পারেন। তবে কারো কারো ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না। ছোটলাটের বউয়ের নাকি শীতের রাতে রাজভবনের সামনের সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আওয়াজে ঘুম হচ্ছিলো না, তাই সাউন্ড কমানোর কমপ্লেন করেছে লালবাজারে। আমিও বলে দিয়েছি, ওখানে আওয়াজ কমাচ্ছো, কমাও, কিন্তু আর কোথাও একফোঁটা কমানো আমি অ্যালাউ  করবো না।  

এ্যাই, এ্যাই, চেঁচামেচি একদম নয়! সবাই এবারে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ো আমরা এবারে কেক কাটবো। সবাই আমার সাথে গলা মিলিয়ে বলো, “Happy birthday to you, Happy birthday to you, Happy birthday dear Rabi.”

শোনো, শোনো, এবার পোগ্গাম শেষ। আমার গরমেন্ট-এর শেষ কাজ হিসেবে আমি রবীন্দ্রনাথকে চিরজীবী করে যেতে চাই, যেমন সত্তোজিতকে করে দিয়েছি। আজ থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সামনের রাস্তার নাম করে দিলাম রবীন্দ্র মরেনি


এবার সবাই হাততালি দাও। কি হলো? হাততালি দিতে বলছি তো!!!? দিচ্ছো না কেন? এ্যাই, এ্যাই......সবাই চুপ কেন?...কি হলো? কি হয়েছে?!!!!!!!!!!!!!!

Wednesday 4 May 2016

অবাক জলপান রিমেক

(সুকুমার রায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে)

পথিক = না! একটু জল না পেলে আর চলছে না! সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু ‘চড়াম্‌ চড়াম্‌’ করছে। কিন্তু জল চাই কার কাছে? দুপুর রোদে গেরস্ত বাড়ির দরজা এঁটে এসি চালিয়ে সব ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ হয়ে ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। বেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন ‘চাব্‌কে লাল’ করে দেবে। পথেও ত লোকজন দেখছিনে। ঐ তো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে একজন আসছে! দেখি, ওনাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।....
পথিক = মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা = জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? উনি তো এখনও ‘জলপাই উৎসব’ শুরুই করেনি। আলুর চপ, তেলেভাজা চান তো অঢেল দিতে পারি—
পথিক = না না, এই গরমে ওসব আমি খাবো না
ঝুড়িওয়ালা = না, আলুর চপের কথা তো আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা তো আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম আর কি
পথিক =  না হে, আমি জলপাই চাচ্ছিনে
ঝুড়িওয়ালা = চাচ্ছেন না তো ‘কোথায় পাব’, ‘কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম ‘অপপ্রচার’ করবার মানে কি?
পথিক = আপনি ভুল বুঝেছেন আমি জল চাচ্ছিলাম
ঝুড়িওয়ালা = জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয় ‘জলপাই’ বলবার দরকার কি? জল আর জলপাই কি এক হল? ‘কথাঞ্জলি’ আর ‘গীতাঞ্জলি’ কি একই বই? ‘ঘুষ’কে কি আপনি ‘অনুদান’ বলেন? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন?
পথিক = ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে। দরকার হয় আমাকে দুটো চড় মারুন, কিন্তু আর আমার মাথা খাবেন না প্লিজ।

 (ঝুড়িওয়ালার প্রস্থান)

পথিক = দেখলে! একটা ‘ছোট্টো ঘটনাকে’ কি বানিয়ে ফেললে! যাক্‌, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি।

   (লাঠি হাতে, হাওয়াই চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ)

বৃদ্ধ = কে ও? ‘লোহাচোর’ নাকি?
পথিক = আজ্ঞে না, আমি ‘সোহ্‌রাব’ নই। আমি কালীঘাটের লোক একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম
বৃদ্ধ = বলো কি হে? কালীঘাট ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতি? হাঃ, হাঃ, হাঃ। ওখানে তো শুনেছি উনি জল ধরছেন, আর কলসীতে ভরছেন। লোকজনকেও বলছেন ‘জল ধরো, জল ভরো’
পথিক = ধুর মশাই, ওসব প্রলাপের কথা ছাড়ুন তো! সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে।
বৃদ্ধ = তা তো পাবেই। ভালো জল যদি হয়, তাঁর ‘অনুপ্রেরণায়’ সবারই তেষ্টা পায়। তেমন জল তো ৩৪ বছরেও খাওনি! বলি বোলপুরের কেষ্টার দেওয়া ‘গুড়জল’ খেয়েছো কোনোদিন?
পথিক = আজ্ঞে না, তা খাইনি-
বৃদ্ধ = খাওনি? অ্যাঃ! বোলপুর হচ্ছে ‘কবিগুড়ি’র জায়গা। কত দেশের জল খেলামসিঙ্গাপুরের জল, লন্ডনের জল কিন্তু বোলপুরের কেষ্টার গুড়জল, আহা, অমনটি আর কোথাও খেলাম না!
পথিক = তা মশাই, আপনার গুড়জল আপনি মাথায় করে রাখুন আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে
বৃদ্ধ = তাহলে বাপু কালীঘাটে বসেই ওখানকার খালের জল খেলেই তো পারতে? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না—ব্যস্‌‌। তোমায় কে এত সাধাসাধি করেছে! গায়েপড়ে কুচুটের মতন ‘কুৎসা’ করবার দরকারটা কি ছিল? আমাদের জল তোমার কি এমন বাঁশ দিয়েছে শুনি!

(রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থানপাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হাসিমুখ প্রকাশিত হইলো)

বৃদ্ধ = কি হে? এত বাঁশ দেওয়া-দেয়ি কিসের?
পথিক = আজ্ঞে না, বাঁশ দেওয়া নয়আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নিলেন না-কেবলই উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম তো রেগেমেগে অস্থির!
বৃদ্ধ = আরে, দূর দূর! তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি? ও ‘বেচারা’ উন্নয়নের জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি? ওর যে ভাই আছে, মাঝেমধ্যে কুইজ-টুইজ করে, সেটাও ত একটা গাধা। ফোটোশপটাও ঠিকমতো করতে পারে না।
পথিক = কি জানি মশাই! জলের কথা বলতেই দেশ-বিদেশের জল, বলে পাঁচরকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ = হুঁম! ভাবলে বুঝি খুব বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকামতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি ২৯৪টা বলে দেব-
পথিক = আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল
বৃদ্ধ = কি বলছো? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, শুনে যাও। চিট ফান্ডের প্রতারিতদের চোখের জল, টেট দিয়ে চাকরি না পাওয়া বেকারদের চোখের জল, বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের চোখের জল, রানুর মায়ের চোখের জল, এছাড়া মদনের পাগলা জল, ‘ত্রিফলা’র জল, এমনকি বাথরুমে জমে থাকা দু’-মগ জল, গোনোনি বুঝি?
পথিক = না মশাই, গুনিনি। আমার অন্য অনেক কাজ আছে।
বৃদ্ধ = সে কি! কাজের কথা উঠছে কেন? আমরা তো সে কবেই আমাদের ১০০শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছি। ৪বছরের মধ্যে ৪০০বছরের কাজ করে দিয়েছি! তুমি তো দেখছি বড্ড কুঁড়ে!

   (সশব্দে বৃদ্ধের জানলাটি বন্ধ হইয়া গেলো)

পথিক = নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও অন্তত পুকুরটুকুর দেখতে পাই কি না।
  
(লম্বা লম্বা চুল, চোখে নীল-সাদা চশমা, হাতে অ্যাপেলের আই-ফোন, পায়ে অজন্তা’র হাওয়াই চটি, একজন মহিলার প্রবেশ)

পথিক = দেখি, এই মহিলা নেহাৎ‌ এসে পড়েছে যখন, ওনাকেই একটু জিজ্ঞাসা করি বরংম্যাডাম, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ম্যাডাম = কি বলছেন? ‘জল’ মিলবে না? খুব মিলবে। একশোবার মিলবে! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছিচারিদিকে যখন উন্নয়নের জোয়ারের জল, হঠাৎ এলো স্টিং কল, চাপে পড়লো দল, বিরোধীরা জোট করে ভেঙে দিল মনোবল, জেলেতে এখনও বন্দি আমার ছাগল, জল চল তল বল কল ফল মিলের অভাব কি? আর কত চান?
পথিক = (স্বগতোক্তি) এ দেখি আরেক পাগল! (জোরে) ম্যাডাম, আমি সে রকম মেলাবার কথা বলিনি।
ম্যাডাম = তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, বাংলা, ইংরাজী না হলে হিন্দি বা উর্দুতে শুনবেন? অলচিকিতে চলবে? আরে জলের নামকরণের উপর তো মশাই আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলেছি।
পথিক = (স্বগতোক্তি) ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি (জোরে) ম্যাডাম! আর কিছু চাইনে, (আরো জোরে) শুধু একটু জল খেতে চাই!
ম্যাডাম = ও, বুঝেছি। শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই। এই তো? আচ্ছা বেশ। এ আর মিলবে না কেন? শুধু একটু জল খেতে চাই১৪৪ এর চাপে প্রাণ আই-ঢাই। একটা ছাপ্পা দেওয়ারও উপায় নাই! বিরোধী-কমিশন মাসতুতো ভাই! আমি সমস্ত রেকর্ড রাখছি তাই, কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে গেলে তোমাদের কে বাঁচাবে ভাই! কেমন? ঠিক মিলেছে তো?
পথিক = আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছেখাসা মিলেছে নমস্কার।
ম্যাডাম = এই, এই ছেলে যাচ্ছো কোথায়? আমার বাকি কবিতাগুলো শুনে যাও...

[বি:দ্র: এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো, ম্যাডামের কবিতা পড়ে এক কবিতাপ্রেমী খোলা চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন: ‘‘দোহাই, আপনি হাতে মারুন, ভাতে মারুন, নবান্নের ছাতে মারুন, আলো নিভিয়ে মারুন, আলো জ্বালিয়ে মারুন, সিঙ্গুর করুন, ঝোলাগুড় করুন, শ্রীকান্ত করুন, ইন্দ্রনাথ করুন, ইংরেজির গুষ্টি করুন, সিঙ্গাপুরি চোষান, মর্তমান চোষান, ঘরে ছেলে ঢোকান, উঠোনে মেয়ে ঢোকান, বাদশাকে লুঙ্গি ডান্স করান, পাগলুকে থোড়া রোমান্স করান সব ঝেলে নেব, মাইরি শুধু কবিতাটা বন্ধ রাখুন, প্লিজ। ওই কবিতা পড়ে কবিতার বাবা কাল গায়ে দড়ি দিয়ে গলায় আগুন লাগিয়েছে।’’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
(শেষাংশ সংগৃহীত)


*********