Wednesday 24 February 2016

বেগমসাহেবার নবাবীয়ানা


ভবানীপুরের মমতাজবানু বেগমসাহেবাকে চেনে না, এমন লোক এ তল্লাটে আছে বলে মনে হয় না! হরিশ চাটুজ্যের ঠিক পাশের বাড়িটায় আজকাল দেশ-বিদেশের নানান গুণীলোকের সমাগম লেগেই আছে। বেগমসাহেবার অনুপ্রেরণায় শিল্পপতি থেকে তোলাবাজ, বুদ্ধিজীবী থেকে চিট ফান্ডের মালিক, চোর থেকে চর, শিল্পী থেকে সাপুড়েসবাই আজ এক সূত্রে বাঁধা।

কিন্তু উনি শুধুই নামেই বেগম নন! চলন-বলন, ঠাট-বাট, মেজাজে একটা স্বভাবসিদ্ধ ‘‘রাফ এন্ড টাফ’’ লুক আছে ওঁর। পান থেকে চুন খসলেই উনি একেবারে ‘‘চাবকে লাল’’ করে দেন, সে মোসাহেব, আমলা, বা পাইক-বরকন্দাজ, যেই হোক না কেন, কারও ছাড় নেই!

এই তো গেল বছর নবান্নের সময় পাড়ার কৃষকদের মধ্যে তুমুল গন্ডগোল। বেগমসাহেবা তখন দার্জিলিং সফরে। না, না, সেবার ডেলোতে নয়, দার্জিলিং-এই ছুটি কাটাচ্ছিলেন। একটু ফাঁক পেলেই তিনি যেমন যান আর কি! কোনও কিছু অঘটনের খবর পেলেই ছুট্টে চলে আসেন। আর ফিরে এসে এক মিনিটেইসব সমস্যার সমাধান করে দেন। বেগমসাহেবার অনুরাগী, অনুগামীরা তাই আগামী ৪০০বছর ওঁকে এইভাবেই সকল কাজে পাশে পেতে চান।

এমনিতে আমাদের বেগমসাহেবার গুণের অন্ত নেই। হেন বিষয় নেই, যা উনি জানেন না! সব তাঁর নখের ডগায়। এই তো এবার বইমেলাতেই তো ওঁর একদিনে ১০টা বই বের হলো। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরাজী, সব ভাষাতেই তিনি সমান পারদর্শী! শুধু  বই বা কবিতা লেখাই নয়, গান করা, নামকরণ করা, তিন আঁচড়ে ছবি আঁকা, গুন্ডা কন্ট্রোল করা, বিরোধীদের মুখে লিউকোপ্লাস্ট পরানোএরকম একশো গুণের বহর তাঁর পারিষদরা যখন-তখন বলে দিতে পারেন।

তবে এমনই অনেক গুণের মধ্যে বেগমসাহেবার একটি অন্যতম গুণ হলো দেনা করা। মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে সেই টাকায় নবাবীয়ানা দেখানো। বেগমসাহেবার কোনো রাখঢাক নেই, তাঁর কথা হলো, ‘ঋণং কৃত্বা, ঘৃতং পীবেৎ’। ফূর্তি করো, দেদার ওড়াও! বেডরুম, ডাইনিং, বারান্দা, কিচেন, এমনকি বাথরুমেও নিজের অয়েল পেন্টিং তাঁর লাগানো চাই। হাওয়াই চপ্পল থেকে শাড়ি, চশমার ফ্রেম থেকে ফাউন্টেন পেন, বেডসিট থেকে পাপোষ, সবকিছুতেই বেগমের নীল-সাদা কম্বিনেশান চাই-ই, চাই। অথচ এই বেগমসাহেবাই লোকের কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত নাকি কান্না কাঁদতো – ‘‘আমার টাকা নেই। আব্বার ৩৪ বছরের দেনা।’’ সেই বেগম সাহেবা এখন সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘‘টাকাটা আমার কাছে কোনো ফ্যাক্টরই নয়।’’ টাকা যে তাঁর কাছে মাটির মতই, সেটা তো ফি বছর ‘মাটি উৎসব’-এ টাকা উড়িয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

আজকাল মাসে অন্তত দুবার টাকা ধার নেওয়াটা বেগমসাহেবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই দেখুন না, গেল বছরের ৮ই ডিসেম্বর তিনি হাজার কোটি টাকা ধার নিলেন। আর তার ঠিক ১৪ দিন পরেই ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের জন্য ২২শে ডিসেম্বর আবার মহাজনদের কাছে থেকে ১,৩০০ কোটি টাকা ধার করলেন। ভেবেছিলাম নতুন বছরে বেগমসাহেবার মতিগতি হয়তো পাল্টাবে! নাহ্‌, তার কোনো লক্ষণই নেই। গত ১২ই জানুয়ারি আবার হাজার কোটি টাকা দেনা করলেন। আর তার ঠিক ১৪ দিনের মাথায় ২৫শে জানুয়ারি, গোপন ফাইল তদন্তের জন্য আবার ১,৫০০ কোটি টাকা। শুধু এই চলতি বছরেই বেগমসাহেবা বাজারের মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন ১৯ হাজার ৩০০কোটি টাকা। মহাজনদের কাছে তাঁর আব্বার কথা তো ছেড়েই দিলাম, শুধু বেগমসাহেবাই  মাত্র গত সাড়ে ৪বছরে ১লক্ষ কোটি টাকার বেশি দেনা করেছেন। তারপরেও শুনতে পাচ্ছি, বেগমসাহেবা নাকি আবার রতন, বিনোদ আর ইমরানের(RBI) কাছ থেকে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২,৫০০ কোটি টাকা আবার ধার করবেন।

তা এত টাকা বেগমসাহেবা ধার করছেন, কিন্তু টাকাগুলো সব যাচ্ছে কোথায়? পাড়ার লোকের মনে প্রশ্নটা উঠছে। কারণ, তাঁরা তো দেখছেন সকাল-সন্ধ্যে যে নাসিরচাচা বেগমসাহেবাকে সুগার-ফ্রি বড়ি দিয়ে চাবানিয়ে দেয়, সেই চাচার ছেলে অনাহারে, অপুষ্টিতে ভুগে যখন বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো, কই, তখন তো তার চিকিৎসার জন্য বেগমসাহেবা সাহায্যের হাত বাড়াননি। রান্নার মাসি, হামিদা বিবির দেশের ভিটেবাড়িটা সেই কবে আইলার সময় ভেসে গেছে। এতবার বলেও হামিদাবিবি আজ পর্যন্ত শুধু সাহায্যের আশ্বাসই পেয়েছেন। বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীদের মাইনে, মাগ্‌গি ভাতা বকেয়া পড়ে রয়েছে, কই সেটা মেটানোর জন্য তো কোনো চেষ্টাই করেননি। রসুলচাচার মেয়েটা ধর্ষিতা হবার পর অনেক হিসাব কষে ক্ষতিপূরণের একটা রেট ঠিক করেছিলেন, কিন্তু চাচা তো সে টাকা নেয়নি। হ্যাঁ, কিছু টাকা অবশ্য তিনি খরচ করেছিলেন যখন বাগদি পাড়ার দুলু বাগদি বিষ মদ খেয়ে মারা গেলো।

তাহলে টাকাগুলো বেগমসাহেবা খরচ করছেন কিসে! নিন্দুকেরা বলেন, বেগমসাহেবা নলবনে ফিস্‌ ফিস্‌করে নাকি অনেক টাকা উড়িয়েছেন। এছাড়া একটা যাত্রার দল নিয়ে বারদুয়েক বিদেশে শো করতেও গিয়েছিলেন। তাতেও বিস্তর খরচ হয়েছিলো। তবে ঐ বিদেশে যাত্রা করে লাভ কিছুই করতে পারেননি। পুকুর পাড়ে, নদীর বাঁধে, রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে পাথর পুঁতেও বেশ কিছু টাকা বেগমসাহেবা উড়িয়েছেন। তবে পাড়ার অধিকাংশ লোকই জানে, আসলে বেগমসাহেবা দেনার সিংহভাগ টাকাই খরচ করছেন মোচ্ছব আর মেলা করে। আর পাড়ার সমাজসেবী ক্লাব ‘দামাল সংঘ’, ‘আমরা চোর’, ‘সিন্ডিকেট সার্বজনীন’- এর পেছনে।


বেগমসাহেবা আগে কথায় কথায় আব্বার ৩৪ বছরের দেনার কথা বলতেন। গত সাড়ে ৪বছরেই তিনি দেনা করার যে বহর দেখিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে ওঁর আব্বা তো দুরের কথা, দেশের যত রাজা-রাজড়া-নবাব-বেগম ১ছেন, সবাইকে উনি পিছনে ফেলে দিয়েছেন একাজে। আর এতে তো রাজ্যপাট লাটে উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে।  বেগমসাহেবার রাজত্বে এলাকার মানুষের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! তাঁরা এখন উপায় খুঁজছেন! 

No comments:

Post a Comment