Sunday 21 February 2016

রমেশবাবুর ডিএ কেন বাড়ছে না?


ফুটবলপাগল রমেশবাবু বরাবরই আর্জেন্টিনার অন্ধভক্ত। তাই ছেলে হবার পর শখ করে তার নাম রাখেন দিমারিয়া। আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার। কিন্তু বিদেশী নাম তো, দেশের সবার আবার জিভ ঘোরে না! তাই দিমারিয়া আঢ্য অচিরেই পাড়ার সবাই ও আত্মীয়দের কাছে হয়ে গেলো ‘ডিএ’, ‘ডি’ ফর দিমারিয়া, ‘এ’ ফর আঢ্য। সবাই তাকে আদর করে এখন ‘ডিএ’ বলেই ডাকে।

এদিকে, ছেলের বয়স প্রায় ৫বছর হতে চলল, কিন্তু এখনও সে হাঁটতে শিখল না! তাই ডিএ-র চিন্তায় রমেশবাবুর কপালে হাত। ডাক্তার, বদ্যি, হাকিম, কবিরাজ, ওঝা, তান্ত্রিক, হোম, যজ্ঞ, ঝাড়ফুক, তুকতাক— কিছুই বাদ রাখেনি করতে। তবুও ডিএ বাড়ে না কেন! হাঁটে না কেন! ‘‘দেখো, আমি বাড়ছি মাম্মি!" বিজ্ঞাপনের চমক দেখে বাজারে গিয়ে কমপ্ল্যান কিনে এনে সকাল-সন্ধ্যা মাদার ডেয়ারিতে গুলে খাইয়েছে। ছেলে আবার চকলেট ফ্লেবার পছন্দ করে বলে তাও কিনে এনেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়, ডিএ আর বাড়ে না!

ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ডাঃ মাঝি বলেছেন, সোমাটোট্রপিক হরমোন (STH), আর গ্রোথ হরমোন (GH) কম ক্ষরণ হচ্ছে। তাই ডিএ-র বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ফিজিওথেরাপি-ও করিয়েছেন। পাড়ার বুড়িদের কথা শুনে ঘন্টার পর ঘন্টা ছেলেকে তেল মাখিয়ে রোদে পুড়িয়েছেন। যদি ভিটামিন D একটু বেশি তৈরি হয়! হাড়গুলি শক্তপোক্ত হয়! যদি ডিএ হাঁটতে শুরু করে! গিন্নি আবার ওপাড়ার পাগলাবাবার কাছ থেকে মন্ত্র পড়ানো ত্রিফলা এনেছেন। পাগলাবাবা বলেছেন, এই ত্রিফলা রাতে বাথরুমে দু’মগ জলে ভিজিয়ে রেখে দিবি, আর সকালে উঠে ছেলেকে খাওয়াবি। তাহলে ‘এক মিনিটেই’ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে রমেশবাবুকে দেখলে প্রায় টিটকিরি মেরে বলে,‘‘কাকু, বিদেশী তেলের বিজ্ঞাপন তো টিভি রোজ দেখাচ্ছে, ওটা একবার ট্রাই করে দেখতে পারেন’’! শুনে তো রমেশবাবু রেগে কাঁই! এই মারে, আর সেই মারে!

ডিএ-র আবার সাতকুলে সাকুল্যে একটি মাত্রই পিসি। তাই ডিএ-কে নিয়ে পিসির চিন্তাও নেহাত কম নয়! উনি আবার সততার পরাকাষ্ঠা, বেজায় ধার্মিক মানুষ! তাই তিনি ডিএ-র বেড়ে ওঠার জন্য বিপত্তারিণীর ব্রত থেকে চন্ডীমন্ডপের মনসাপুজো, মা, মাটি থেকে ঘটি, বাটি সব ধরণের পুজো-আচ্চা করেছেন, সিন্নি চড়িয়েছেন,  উৎসব পালন করেছেন। মুক্তহস্তে দান ধ্যানও করেছেন। আর এসব কাজে উনি কোনো বাছ্‌-বিচার করেন না। অন্ধ ফকির থেকে পাড়ার ক্লাব, সবাইকে দেদার অর্থ সাহায্য করেন। কাউকে দু’হাজার, তো কাউকে দু’লাখ। এমনকি, চুল্লু খেয়ে দখিনপাড়ার মর্জিনা বিবির খসমটা যখন মারা গেলো, তাকেও দু’লাখ টাকা দিয়ে দিলেন! 

দানের এমনই বাতিক যে রমেশবাবুর সাইকেলটাও কাকে দান করে দিলেন! পরে রমেশবাবু দিদিকে বকাবকি করলে পরে উনি বলেন, ‘ছাড়তো বাপু, আগে আমার ডিএ বড়ো হোক, হাঁটতে শিখুক, অমন সাইকেল তোকে আমি পাঞ্জাব থেকে ৪০হাজার আনিয়ে দেব।’ ডিএ-র পিসি ভিখারীদেরও পেটপুজো করিয়ে দরিদ্রনারায়ণসেবা দেন, পূণ্যি লাভের জন্য। ইলিশ, মটন, বাগদা, ল্যাংচা সবই নিজে হাতে খাওয়ান। আর দেশ-বিদেশের ভিখারীগুলিও জড়ো হয়ে যায় ফ্রি-তে ভালো-মন্দ খাবার লোভে। মাঝে মধ্যে তারা ডিএ-র বৃদ্ধির কামনা না করে, পিসির গুণকীর্ত্তন করতে থাকেন। পিসিরও দিল তাতে ‘‘গার্ডেন গার্ডেন’’ হয়ে যায়। দেশের এমন কোনো তীর্থস্থান বাকি নেই, যেখানে পিসি পুজো দিয়ে পাথর পুঁতে আসেননি! এমনকি সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ, লন্ডনেও পুজো দিয়ে এসেছেন! কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! ডিএ-র বৃদ্ধির তেমন কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না!

পাড়ার সমবয়সী অন্য ছেলেরা আজ ডিএ-র থেকে কতো বেড়ে গেছে! সত্যিই দেখলে কষ্ট হয়। পাশের বাড়ির নরেনখুড়োর ছেলেটা তো তরতর করে বাড়ছে! এখনই ডিএ-র সাথে পার্থক্য ৫৪ সেন্টিমিটার। পাড়ার লোকে অবশ্য বলে নরেনখুড়োর প্রচুর কালো টাকা। তাই ছেলেকে দামি দামি ভালো ভালো সব খাবার খাওয়ায়। এইতো পরশু শুনলাম, নরেনখুড়ো আবার নাকি আমেরিকায় তার এক জিগরি দোস্তের কাছথেকে কী একটা ক্যাপসুল এনেছে, তা খাইয়ে ছেলেকে নাকি আরো লম্বা করে ফেলবে, তখন তার নাগাল পাওয়াই নাকি দুষ্কর হয়ে যাবে।  

রমেশবাবুও কানাঘুষোয় সেকথা শুনেছে। কিন্তু রমেশবাবুর অতো পয়সা কোথায়! তার উপর বাবার ৩৪ বছরের দেনা শোধ করতে হচ্ছে! তবে দু’দিন আগে এক ফকিরবাবা এসে একটা জলাঞ্জলির মন্ত্র শিখিয়ে গিয়েছেন। যেটা সকাল-সন্ধ্যা জপ করলে বিন্দু বিন্দু করে ডিএ-র বৃদ্ধি হবে। আর ২০১৬ জানুয়ারির শেষে ডিএ ১০ সেমি বৃদ্ধি পাবে। এটাই এখন রমেশবাবুর একমাত্র আশার আলো। একটু হলেও দিমারিয়া আঢ্য, মানে সাধের ডিএ শেষ পর্যন্ত বাড়বে তো! কিন্ত ঐ আশায় কেবল চাষা মরে না, মরে রমেশবাবুর মতন সাধারণ মানুষও। জানুয়ারি কবেই শেষ হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিও শেষ হতে চললো তবুও ডিএ বাড়ছে না।

এত কিছুর পরেও ডিএ-র বৃদ্ধি না হওয়াতে রমেশবাবুর মনে একটা খটকা লাগলো। তাই গোপনে তদন্ত শুরু করলেন তিনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই ফল হাতেনাতে পেলেন, যা দেখে রমেশবাবুর চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ! আসলে সরষের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল পেত্নী! যে দিদিকে বিশ্বাস করে রমেশবাবু তাঁর ছেলের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সেই দিদিই, মানে ডিএ-র প্রাণের পিসিই, তার ভাইপোর এই সর্বনাশের মুল কান্ডারী! 

গত একবছর ধরে রমেশবাবু তাঁর দিদিকে ডিএ-র এর চিকিৎসার জন্য মোট ষোলো লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই পুরো টাকাটাই দিদি নিজের নাম প্রচারের জন্য দান-খয়রাতি করে উড়িয়েছেন। এমনকি উল্টে পাড়ার লোকের কাছ থেকে বাইশ লাখ টাকা দেনা করে বসে আছেন। এখন দেনা শুধতে তো ভিটেমাটি নিয়ে টানাটানি হবে! রমেশবাবু তাই বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁর ডিএ-র বৃদ্ধি যদি সুনিশ্চিত করতে হয় তাহলে এই অলক্ষুণে দিদিকেই বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। পাড়ার লোকেদেরও একই মত। 

3 comments: