Sunday 28 February 2016

“ওই নোবেলের কেতন ওড়ে কথাঞ্জলির ঝড়; তোরা সব cool cool cool কর। ”


শ্রদ্ধেয় রবিবাবু,

আপনাকে প্রশংসা করে অনেকেই অনেক চিঠি লেখে। কিন্তু আমি সেই ধাতুতে গড়া নই। একটা নোবেল পেয়েছেন বলে আপনাকে মাথায় তুলে নাচব, সে বান্দা আমাকে পাননি। বরং আমি বলব, আপনার জন্য বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রতিভারা উপরে উঠতে পারছিল না।

আপনি বয়স্ক লোক তাই সবাই সম্মান করে, আর সেই সুযোগে আপনি বছরের পর বছর, এমনকি মৃত্যুর পরেও সিংহাসনে বসে আছেন। কিন্তু সাহিত্যের সিংহাসন কি বাসের সিনিয়র সিটিজেন সিট, যে পাকা চুল দাড়ি দেখলে ছেড়ে দিতে হবে?

আপনি ভেবেছিলেন, একটা নোবেল পেয়েছেন বলে চিরকাল রাজা হয়ে থাকবেন? না, তা হবে না। জেনে রাখুন নোবেল নিয়ে আপনার বড়াই করার দিন শেষ। এই বাংলাতেই এমন একজন এসেছেন, যিনি যে কোন দিন নোবেল পাবেন। এবং অর্থনীতি, শান্তি, বিজ্ঞান এই সব এলিতেলি বিষয়ে নয়, পাবেন আপনার মতোই সাহিত্যে। অস্কার পাওয়াটা তো তার কাছে নস্যি!

আপনি নোবেল জিতেছিলেন কেন? গীতাঞ্জলির জন্য? না, গীতাঞ্জলির জন্য নয়। সবাই জানে বাংলার মতো ফালতু ভাষায় লেখা বই নোবেল পেতে পারে না। তাই আপনি গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন song offerings। আর সেই অনুবাদের দৌলতেই আপনি রাজা হয়ে বসেছিলেন। ভেবেছিলেন, কেউ আপনাকে হটাতে পারবে না?                                          

ভুল ভেবেছিলেন। স্বর্গ থেকে নেমে দেখুন, আপনারই অস্ত্রে আপনাকে বধ করার মতো প্রতিভা বাংলায় এসে গেছে। তার নামথাক, গুরুজনদের নাম ধরতে নেই। তিনি গত বছরেই ‘কথাঞ্জলি’ নামে একটি অমর সাহিত্য লিখে আপনার গীতাঞ্জলির মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছিলেন। আর এবছর সেই কথাঞ্জলির অনুবাদ করেছেন। আপনার গীতাঞ্জলির অনুবাদ song offerings কথাঞ্জলির অনুবাদ বোধহয় অনুবাদ talk offerings।

অনুবাদের কথায় পরে আসব, আগে দেখি কিভাবে তিনি আপনার কফিনে একের পর এক পেরেক ঠুকে দিচ্ছেন। আচ্ছা বলুন তো আপনি কটা ভাষায় লিখতে পারতেন? বাংলা আর ইংরাজিতে অনুবাদ। কিন্তু ইনি বাংলা, ইংরাজি, হিন্দি, এমনকি উর্দুতেও লিখতে পারেন। পাশাপাশি ইংরাজিতে অনুবাদও করতে পারেন। এঁর ইংরাজি কবিতা পড়বেন?

Melody of Vina কবিতায় তিনি লিখেছিলেন,
Methinks, I am alive
Are you alive?
This then life’s motto shall be
The tune- Life’s instrument will be।
এই ইংরেজির নমুনা পড়েই বুঝতে পারছেন কথাঞ্জলির অনুবাদ কেমন হবে। গীতাঞ্জলীর অনুবাদ song offerings এর থেকে ঢের ভালো হবে কথাঞ্জলির অনুবাদ talk offerings। আর সেই অনুবাদের জন্য নোবেল আসবেই। মনে রাখবেন নোবেল কমিটি নির্বাচনী আচরণবিধির আওতায় পড়ে না। তাই, সামনে নির্বাচন এই অজুহাত দেখিয়ে কথাঞ্জলির জয়যাত্রা ঠেকানো যাবে না।

আপনি নাকি গান লেখেন। কঠিন কঠিন গানের কথা ছেড়ে দিন। একটা সহজ গানের কথা ভাবুন, “শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে।কিন্তু ইনি লিখেছেন,
শাল পিয়ালির পাতায় ছায়ায় নীরবে নিঃশব্দে
নাচবে কোয়েল, গাইবে ঊষা আমলকী নাচবে সন্ধ্যে।
আপনি নিজেই বলুন, ভর সন্ধেবেলায় ঊষার গানের সঙ্গে আমলকি নাচছে, এটা আপনি ভাবতে পারতেন?

আপনি তো বসন্ত নিয়ে অনেক গান-কবিতা লিখেছেন। এঁর লেখার নমুনা দেখুন।
বসন্তের বর্ণে দীর্ঘশ্বাস
মুমূর্ষু বর্ণের ফুল বাগিচা
ঘন অরণ্যে আগুনের ছাই
জ্বলনে বিধ্বস্ত করমচা।
অসাধারণ! নিপীড়িত মানুষের উপমা হিসাবে জ্বলনে বিধ্বস্ত করমচা ব্যবহার শুধু বাংলায় কেন, বিশ্বসাহিত্যে বিরল। আমাদের মন শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে অবনত হয়। আপনি নিজেই বলুন না, কারটা ভালো?                       

আবার দেখুন, আপনি আফ্রিকা বলে একটা কবিতা লিখেছিলেন। তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায়নি। ইনিও আফ্রিকা বলে একটা কবিতা লিখেছেন। সেখানে বলেছেন,
‘‘অনেক রক্তে যুদ্ধাঞ্জলি
যুদ্ধের হোক বিরতি’’
শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করুন। যুদ্ধাঞ্জলি। মানে যুদ্ধের অঞ্জলি। কি ভাষা! কি ভাব! কি অনুপ্রাস! যেন বৈদ্যনাথের চ্যবনপ্রাস! আপনি পেরেছেন বঙ্গ-সরস্বতীকে এমন অঞ্জলি দিতে?

আসলে অঞ্জলি শব্দটির প্রতি এই নবীনা কবির একটু মোহ আছে। ‘কথাঞ্জলি’ বইতে, তিনি লিখেছিলেন,
জীবন-জীবনী-জীবন প্রন্থে জীবন জীবনাঞ্জলি
শতক চলে আবার আসে নতুন শতাঞ্জলি

পারবেন এমন লিখতে? কিন্তু ইনি পেরেছেন। কথাঞ্জলি বইটি পড়ে পাঠক মহলে ধন্য ধন্য রব উঠেছিল। অন্য কেউ হলে ওই বই লেখার পর খুশিতে পাঁচ বছর বিশ্রাম নিত। কিন্তু দিদির অভিধানে বিশ্রাম শব্দটিই নেই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি একের পর এক বই লিখে আমাদের নবজীবন দান করছেন। নবজীবন মানে সত্যিই নবজীবন। সাহিত্যমোদীরা বলেন, সব বই নাকি জীবনদায়ী ঔষধের মত। মৃতপ্রায় মানুষের কানের কাছে সে সব বই পড়ে শোনালে রোগী বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পি টি ঊষার মতো ছুটতে থাকেন।

এবারের বইমেলাতেও দিদির দশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে একটির নাম নামাঞ্জলি।’’ ভাবুন! একবার ভাবুন! একা কথাঞ্জলিতে রক্ষা নেই, সঙ্গে নামাঞ্জলি। আচ্ছা এই নামাঞ্জলি মানে কী? নামাঞ্জলি মানে নামের অঞ্জলি। এই বই দেখে বাবা মায়েরা সদ্যোজাত সন্তানের নাম রাখতে পারেন। আর কি সব অত্যাধুনিক নাম। আলনা, আলচিকি, আলমোড়া-এসবও না কি ছেলেমেয়েদের নাম। বিশ্বাস না হয়, পাতা ঊল্টে দেখুন। সুকুমার রায়ের হযবরল- হিজিবিজিবিজ সবকিছুর নামকরণ করত। তার বাড়ির নাম ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছাতার নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু। সেও এমন সব নাম ভাবতে পারেনি।

ও, রবীন্দ্রনাথবাবু, আপনি কখনও নামকরণ নিয়ে আস্ত একটা বই লিখেছেন? লেখেননি। আপনি নাকি অমর্ত্য সেনের নামকরণ করেছিলেন। আর কাকতালীয়ভাবে তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন। আজকের বাংলার বাবা-মায়েরা ঝুঁকি নিয়ে ছেলের নাম আলমোড়া, মেয়ের নাম আলনা রাখুক। তারাও অমর্ত্য সেনের মতো নোবেল পাবে।

রবিবাবু, আপনি নিজেই তো লিখেছিলেন, “হেথা হতে যাও পুরাতন হেথা নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে।জেনে রাখুন, বাংলায় এখন নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে। সেই নতুন খেলায় গীতাঞ্জলি হল মেট্রো স্টেশন, বাড়ি তৈরির প্রকল্প। এই বাংলায় সরকারি মন্ত্রীরা প্রচার করছেন, আপনি গীতাঞ্জলির স্রষ্টা নন। গীতাঞ্জলির স্রষ্টা আমাদের নতুন কবি।

সেই কবির কীর্তিকলাপ দেখে আমরা fool- fool- ঢলে পড়ছি। কথাঞ্জলি পড়ে আমরা cool থাকছি। আর আপনার বিরোধীরা অনুরাগীরা রাগে, হতাশায় cool cool করে ঘামছে। তাতে আমাদের বয়েই গেছে। আমরা জানি আজি নোবেল জাগ্রত দ্বারে। ওই নোবেলের কেতন ওড়ে কথাঞ্জলির ঝড়। তোরা সব cool cool cool কর।

ও, রবীন্দ্রনাথবাবু মূর্ছা গেলেন নাকি? ও, রবীন্দ্রনাথবাবু……
(সংগৃহীত)


No comments:

Post a Comment