Thursday 3 March 2016

✍✍✍✍✍ 'ছবি রহস্য' ✍✍✍✍✍


প্রায় সাড়ে চার বছর বিদেশে কাটিয়ে জটায়ুবাবু মানে আমাদের লালমোহন গাঙ্গুলি আজই দেশে ফিরলেন। আর ফিরেই সটান হাজির ফেলু মিত্তিরের বাড়ি। অনেকদিন পর জটায়ুকে পেয়ে ফেলুদাও দারুণ খুশি। বৈঠকখানার ঘরে বসে সন্ধ্যাবেলা চলল জমিয়ে আড্ডা, সঙ্গে নিমাই-এর দোকানের গরম আলুর চপ আর সিঙাড়া।

ড্রয়িংরুমে জমিয়ে বসে তো লালমোহনবাবু তাঁর বিদেশ ভ্রমণের নানান অ্যাডভেঞ্চার গল্প শোনাচ্ছেন। এমন সময় হঠাৎ ফেলুদার বাঁ পকেটে রাখা অ্যাপেলের আই-ফোনে টিং টিং করে শব্দ হলো। ফেলুদা ফোনটা বার করে দেখল ‘সবুজবাজার’ থেকে মিঃ শামিম হোয়াটস্‌অ্যাপে একটা ছবি পাঠিয়েছেন, সঙ্গে দু’-লাইন লেখা – ‘‘মিত্তিরমশাই, যদি কেসটা একটু দেখেন।’’ ফেলুদা সোফায় বসে বসেই চারমিনারের অবশেষটুকু ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতন ছুড়ে দশ হাত দুরের জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে লালমোহনবাবুকে বললেন, ‘‘চলুন, একটু ‘পরিবর্তন’-এর কলকাতা ঘুরে দেখবেন। তোপ্‌সে, তুইও রেডি হয়ে নে, পাঁচ মিনিট’’ফেলুদা পাশের রুমে যেতেই লালমোহনবাবু বললেন ‘‘ও, তপেশ ভাই, তোমার দাদাও আজকাল আই-ফোন ব্যবহার করছেন!’’ হাসিমুখে তপেশ বললো, ‘‘ফেলুদা এখন অনেক আপডেটেড, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে, নিয়মিত টুইটও করে থাকেন।’’ লালমোহনবাবু তো শুনে হা! ফ্যালফ্যাল করে তোপ্‌সের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

লালমোহনবাবু আজকে তাঁর গাড়ি আনেননি তাই তিনজনে রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। দু’-তিনটে ট্যাক্সি সটান মুখের উপর বলে দিলো, ওদিকে যাবো না। লালমোহনবাবু রেগে গিয়ে বললেন, ‘‘যাবেন না যখন, তাহলে ট্যাক্সির গায়ে নো রিফিউজাল লিখে রেখেছেন কেন? আপনাকে যেতেই হবে।’’ ট্যাক্সি ড্রাইভার লালমোহনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘‘আপনি কে মশায়? কোন হরিদাস পাল!’’ ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা শুনে খানিকটা দমে গিয়ে ফেলুদাকে লালমোহনবাবু বললেন, ‘‘এই নীল-সাদা ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো তো দারুণ অভদ্র!’’ ফেলুদা মুচকি হেসে বললেন, ‘‘এখন গোটা বাংলাই তো নীল-সাদা। দেখছেন না, সমস্ত ল্যাম্পপোস্টগুলোর গায়ে কেমন নীল-সাদা সাপ পেঁচিয়ে আছে!’’ লালমোহনবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘‘মশাই ল্যাম্পপোস্টগুলো সব এরকম ত্রিশূলের মতন কেন?’’ ফেলুদা বললেন, ‘‘ওগুলো ল্যাম্পপোস্ট কাম্‌ বজ্রনিরোধক। ওই যে, বাড়ির সুরক্ষার জন্য বাড়ির ছাদে যেমন বজ্রনিরোধক লাগানো থাকে, ঠিক তেমনি  পথচলতি মানুষ ও ফুটপাথবাসীর সুরক্ষার জন্য ওটা লাগানো হয়েছে।’’

অবশেষে অনেক কষ্টে বেশি ভাড়া দিয়ে একটি ট্যাক্সি পাওয়া গেলো। পিছনের সিটে লালমোহনবাবু আর তপেশ বসলেন, আর সামনে ফেলুদা। ফেলুদা ড্রাইভারকে বললেন ‘সবুজবাজার’  চলো। পিছন থেকে লালমোহনবাবু বললেন, ‘‘ও মিত্তিরমশাই, তবে যে বললেন লালবাজার যাবেন!’’ ফেলুদা পকেট থেকে আবার একটা চারমিনার বার করে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ঢোকা হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে সন্তর্পণে ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন – ‘‘লালমোহনবাবু, পরিবর্তনের গুঁতোয় অনেক কিছুই পাল্টে গেছে এখন। এতদিন যেটা ‘লালবাজার’ ছিল, এখন সেটাই ‘সবুজবাজার’’’ লালমোহনবাবু অবাক হয়ে বললেন ‘‘বলেন কি মশাই! আর কি কি পরিবর্তন হয়েছে শুনি!’’ ফেলুদা সিগারেটের জমে যাওয়া ছাইটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, ‘‘ধর্মতলা এখন সহিষ্ণুতলারবীন্দ্র সদন এখন শহীদ মদন, নন্দন এখন বুদ্ধিজীবী চক, ডালহাউসি এখন ডিএ-হাউসি, চাঁদনি চক এখন চাঁদনি চপ, রাসবিহারী এখন রাসবাঙালী, জগুবাজার এখন জাগো বাজার, বৌ-বাজার এখন কন্যাশ্রী বাজার, নলবন এখন বৃন্দাবন, কটা বলবো মশাই! এমনকি এই যে রাস্তার উপর দিয়ে আমরা যাচ্ছি তার নাম লি-রোড থেকে পাল্টে করা হয়েছে ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’’’ লালমোহনবাবু শুনে বললেন, ‘‘এতো ‘কেলেঙ্কারিয়াস’ ব্যাপার মোশায়’’ তোপ্‌সে পাশ থেকে বলল,‘‘কেলেঙ্কারিয়াস নয়! এটা ‘জর্জান্ডিয়াস’ ব্যাপার।’’

চিত্তরঞ্জন চিরুনি হয়ে বি বি ব্যানার্জি মরনি দিয়ে সবুজবাজারে পৌঁছতে সময় লাগলো পাক্কা ১ঘন্টা। তারপর শামিম সাহেবের কেবিনে ঢুকতেই উনি চিন্তিত মুখে বললেন, ‘‘দারুণ ফ্যাসাদে পড়েছি  মিত্তিরমশাই। দেখুন না এই ছবিটা, ক্ষুদিরামের ছবির নিচে কে ভগৎ সিং, আর নেতাজীর নীচে চিত্তরঞ্জন লিখে কুৎসা রটাচ্ছে। গোটা শহর এই নিয়ে ছিঃ ছিঃ করছে।’’ ফেলুদা মিনিট পাঁচেক ভালো করে ছবিদুটো দেখে বললেন, ‘‘দুটোতেই একটা কমন শব্দ মিসিং।’’ মিঃ শামিম বললেন, ‘‘মানে!’’ ফেলুদা বললেন, ‘‘ছবিতে আরও একটা শব্দ ছিল কিন্ত কেউ সেটাকে খুব সন্তর্পণে মুছে দিয়েছে। ক্ষুদিরামের ছবির নিচে লেখা ছিলো ‘প্রচারে’ ভগৎ সিং। আর নেতাজীর ছবির নিচে ‘প্রচারে’ চিত্তরঞ্জন। দু’জন দু’জনের জন্য প্রচার করছেন ঐ যেমন বাকি পোস্টারগুলোতে নেত্রীর ছবির নিচে থাকে আর কি, প্রচারে- হাতকাটা কালু, ল্যাংড়া লালু। অনুপ্রেরণার মতন একই স্টাইল। অনুপ্রেরণায় উনি থাকেন, আর প্রচারে ওনার দামালরা থাকে।’’ সাহেব বললেন, ‘‘যাক! নিশ্চিত হওয়া গেলো এটা তাহলে শিক্ষিত তিনুদের কাজ নয়। তাহলে এটাকেও সিপিএমের চক্রান্ত বলে বাজারে চালানো যেতে পারে।’’


সাহেবের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পর লালমোহনবাবু বললেন, ‘‘ভগৎ সিং লেখাটা মুছে দিয়ে নিচে ক্ষুদিরাম লিখে দিলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো!’’ ফেলুদা হেসে বললেন, ‘‘তাহলে তো উপরের ছবিটা পাল্টে হনুব্রতর করতে হতো। আপনি বুঝবেন না মশাই। সবে ফিরেছেন তো! কিছুদিন থাকুন, তারপর সব বুঝবেন। শুধু এটুকু বুঝে নিন, আপনার লালমোহন নাম পাল্টে সবুজমোহন না করলে, আপনিও রেশন পাবেন না।’’

No comments:

Post a Comment