Saturday 19 March 2016

মাথার ব্যামো




পিসির মাথার ব্যামোটা আজকের নতুন নয়! এটা অনেকদিনের পুরনো অসুখ। আর গরম পড়লেই সেই ব্যামোটা আরও বাড়তে থাকে। তাই তো পিসি সবসময়ই ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ থাকতে চান। আরে পিসি মানে আমার নিজের পিসি নয়। আমাদের সার্বজনীন পিসি, আমাদের পাড়ার কালিপিসি। এবছর শীতটা দুম করে চলে গেলো, আর গরমটা হুট করে পড়ে গেলো। বসন্তটা মাঝখান থেকে ভ্যানিস হয়ে গেলো। আর গরম পড়তেই পিসির ব্যামোটা শুরু হয়ে গেল। যত দিন যাচ্ছে গরমও বাড়ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিসির ব্যামোও চড়চড় করে বাড়ছে। তবে পাড়ার লোক পিসির এতে  আদৌ অতিষ্ঠ নয়। তারা তো জানেই যে পিসির মাথার ব্যামো আছে। তাই এটাকে জাস্ট এনজয় করছে। মাঝে মধ্যে পাড়ার বখাটে ছেলেগুলো একটু পিনিক্‌ দেয়, আর তাতেই পিসি সারাদিন উল্টোপাল্টা বকবক করতে থাকে।

কালিপিসির সাথে কংস-দার ব্রেক-আপ হয়েছে, তা প্রায় বছরখানেক হলোপিসির তিরিক্ষি আচরণই একপ্রকার কংসদাকে বাধ্য করেছিল সম্পর্ক ছেদ করতে। আসলে পিসির জীবনে তো শুধু কংসদা একাই আসেনি! আরও অনেকে এসেছিল। পটলখুড়োকে মনে আছে তো! পটলখুড়োর গেরুয়া মাফলারের প্রেমে ফিদা হয়ে গিয়েছিল তো পিসি। পটলখুড়ো তার আধবোজা-আধখোলা চোখের অ্যাডভান্টেজ নিয়ে সবার সামনেই পিসিকে চোখের ইশারা করতেন। কেউ বুঝতেই পারতো না। তবে পিসি কিন্তু সিগন্যালটা ঠিক ধরতে পারতেন। 

পটলখুড়োর ভাই নরেনখুড়োকেও পিসি ছাড়েনি। সেই যে বার নরেনখুড়ো যখন গুজরাট থেকে ফিরল, পিসিই তো তাকে এক তোড়া গোলাপ আর একটা ভ্যালেনটাইন কার্ড দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল। সেই থেকে পিসির সাথে ওনার গোপন কেমিস্ট্রি। তবে পিসি কারোর কাছে সে কথা স্বীকার করে না। ওপাড়ায় নরেনখুড়োর মুদির দোকানে প্রায়ই পিসির আনাগোনা। এই নরেনমুদির সাথে পিসি নজরুল মঞ্চে জলসা শুনতে গিয়ে একান্তে গল্প করেন। খুড়োও পিসির জন্য তেওরীর লাড্ডু নিয়ে আসেন। তবে প্রকাশ্যে কেউই স্বীকার করে না, তাদের মধ্যে গোপন বোঝাপড়ার কথাতবে পাড়ার লোক সবই বোঝে। পাড়ার বয়স্করা প্রায়ই বলে থাকেন, এই মেয়েটা যে আর কটা ছেলের মাথা খাবে কে জানে!

পাড়ার মহিলামহলে এখন আলোচনার বিষয় একটাই, কংসদা আর বামাচরণবাবুর মেয়ের কেমিস্ট্রি। দুজনের বন্ধুত্বের কথা, একে অপরের প্রতি সহানুভূতির কথা, দুজনে একসাথে মিলে কালিপিসির দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করার কথা আজ পাড়ার প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। আর সেটাই হয়েছে পিসির কাল। এই তো সেদিন দুপুরবেলায় ঘন্টাখানেক ধরে সুমনদের বাড়িতে পাড়ায় মহিলাদের জটলায় কংসদা আর বামাচরণবাবুর মেয়ের প্রসঙ্গ নিয়েই চর্চা হচ্ছিলো। আচমকা পিসি সেখানে গিয়ে হাজির! সুমনের মা পিসিকে কংসদার কথা জিজ্ঞেস করতেই পিসি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠলো ‘‘ওরা যা খুশি করে করুক। ওরা মিলেনিয়াম পার্কে যাক, বা ভিক্টোরিয়ায় যাক। ওরা চিনেবাদাম খাক, বা ফুচ্‌কা খাক, তাতে আমার কি! আমি ওদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’’ নিজের অতীতের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পিসি বললো, ‘‘তবে ওদের এমন রাস্তায় রাস্তায় হাত ধরে ঘোরা কিন্তু মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। অবশ্য এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার আমি নাক গলাব না।’’

কিন্তু নাক গলাবো না বললেও রাগেক্ষোভে পিসির কথার তোড় ছুটতেই লাগলো। গজ্‌গজ্‌ করতে করতে বলেই চললো, ‘‘শুনলাম, দুজনে জুটি বেঁধে আজ মুর্শিদাবাদ তো কাল বর্ধমান, আজ শিলিগুড়ি তো কাল মেদিনীপুর ছোটাছুটি করছে। তবে আমি ওদের এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না। কংস ভুলে গেলো কি করে বামাচরণবাবুর সব কথা! সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে শেষে কিনা ঐ মেয়ের হাত ধরল! আর বলিহারি মেয়েটাকে, তোর বাপকে যে এককালে এতো গালাগালি দিয়েছিল, আজ তুই কিনা তার হাত ধরেই ড্যাং ড্যাং করে রাস্তায় ঘুরছিস! ওরা সাবালক, আমি ওদের ব্যাপারে কেন মন্তব্য করতে যাব! তবে এককালে কংস আমার খুব ক্লোজ ছিল, তাই কংসর জন্য খুব কষ্ট হয়। কংসর ভালোর জন্যেই বলছি ওর অবিলম্বে এই সম্পর্ক ব্রেক করা দরকার। ও জানে না বামাচরণবাবুর মেয়ে ওর কতো ক্ষতি করতে পারে! মরুকগে ওরা, আমি কেন বারণ করবো!


আরও দু-চারটে খিস্তি দিয়ে পিসি সুমনদের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বিড়বিড় করে একটাই কথা বলতে লাগলো, ‘‘পাড়ার সবার কাছে ভালোমানুষ সাজা! দাঁড়াও, আমার নামও কালি, ওদের মুখ মুখোশ দুটোই খুলে দেব।’’ 

পিসি বেরিয়ে যাবার পর সুমনের মা যখন বলল, ‘‘ওরে, রাঁচিতে বুকিং কর! পিসি বুঝি এবারে না সত্যিই পাগল হয়ে যায়!’’ উপস্থিত বাকি মহিলারা হো হো করে হেসে উঠলো।

1 comment: