Tuesday 8 March 2016

সাহিত্যপ্রেমী কালীপিসি

‘‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী, আর পৃথিবীর পরে ঐ নীল আকাশ। তুমি দেখেছ কি ----।’’

আচ্ছা, হেমন্তবাবু যদি আজকের দিনে এই গানটি গাইতেন তাহলে কি গানের  লাইনগুলি একই থাকতো!! নাকি পরিবর্তনের ঠেলায়, উন্নয়নের জোয়ারে, সততার চাপে লাইনগুলি এলোমেলো হয়ে যেতো!! সাদা আকাশের নীচে এই নীল পৃথিবী, আর নীল পৃথিবীর পরে ঐ সাদা আকাশ। তুমি দেখেছ কি এমন নীল-সাদা কম্বিনেসান --------।

হ্যাঁ, দিনের পর দিন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আমার কৌতূহল যেন বেড়েই চলেছে! আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্য বস্তুটি কমই বুঝি। কবিতার ভাবার্থ ব্যাখ্যা করার থেকে কোয়ান্টাম থিওরি ব্যাখ্যা করা আমার কাছে অনেক সোজা, সনেটের শব্দ বিন্যাস ও লাইনের হিসাব রাখার চেয়ে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস সহজ মনে হয়, ভাব সম্প্রসারণের দু’-লাইন থেকে দশ লাইন তৈরি করার চেয়ে স্পর্শ পদ্ধতিতে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করা কম ঝামেলার।

তবে ইদানিং বাংলায় বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ পার্ট-টু শুরু হবার পর থেকেই আমার সাহিত্যের প্রতি কৌতূহল বাড়তে শুরু করেছে। রবীন্দ্র অনুরাগী বা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাই হার্ড ফ্যান’ আমি কোনোকালেই ছিলাম না। তবে ওঁকে অশ্রদ্ধা করি এমন কথা নিন্দুকেরাও বলতে পারবে না। যেদিন থেকে ওঁর সবচেয়ে বড়ো অনুরাগী, আমার  কালীপিসি রবীন্দ্রনাথকে ট্রাফিক সিগনাল পোস্টে ঝুলিয়ে দিলেন, সেদিন থেকেই আমার নিয়মিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা শুরু হলো। আমার কালীপিসির কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত জ্ঞান। তা সে রামমোহনবাবুর বিধানসভার সদস্য হওয়া হোক বা রবীন্দ্রনাথের ঝর্ণা দেখে ‘মুক্তধারা’ লেখা।

রবিবাবুর হাতে ফলের রস খেয়ে গান্ধীজীর অনশন ভঙ্গের কথা উনিই প্রথম প্রকাশ্যে আনেন। আর সরস্বতী পুজো যে বাঙালীর বসন্ত উৎসব সেটা উনি বলার পরই আপামর বাঙালী উপলব্ধি করেন। ওঁর কাছ থেকেই আমরা বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যের এমন কিছু হারিয়ে যাওয়া অপ্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি। আর ওঁর সাহিত্য জ্ঞান! মশাই উনি বাংলা ইংরেজি হিন্দি উর্দু অলচিকি পাঁচটে ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। প্রায় ডজনখানেক বই লিখে ফেলেছেন। শুধুমাত্র নামকরণের উপরেই একটা আস্ত বই। ওঁর মতন জ্ঞানী মহিলা বাংলায় এর আগে জন্মায়নি।

তাই কৌতূহলবশত কালিপিসির কাছে জানতে ইচ্ছা করে, পিসি  বিভূতিবাবু কি  ডিসকভারি চ্যানেল দেখেই ‘চাঁদের পাহাড়’ লেখেন! নজরুল কি অমিতাভের কুলি সিনেমা দেখেই ‘কুলি মজুর’ লেখেন! বঙ্কিমচন্দ্র কি জি বাংলায় মিরাক্কেল দেখেই হাস্যরস সমৃদ্ধ ‘লোক রহস্য’ লেখেন! তারাশঙ্করবাবু কি অমরনাথ, ইস্‌কন, তিরুপতি, তারাপীঠ, কালিঘাট, দেওঘর, দক্ষিনেশ্বর, পুরীর প্যাকেজ ট্যুর ঘুরে এসে গণদেবতা উপন্যাস লেখেন! জীবনানন্দবাবু বাংলার উন্নয়নের জোয়ার দেখেই কি বলেছিলেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি ---’, সুকুমার রায় কি আপনাকে দেখেই অনুপ্রানীত হয়ে ‘আবোল-তাবোল’ লেখেন!

সুনীলবাবুকে নীললোহিত বলার পিছনে কি আপনার নীল-সাদার অবদান আছে! মানিকবাবু ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ লিখেছিলেন কি গাড়ির বোনেটের ওপর নাচ দেখেই, সৈয়দ মুজতবা আলি সিঙ্গাপুর আর লন্ডন ভ্রমণ করে এসেই লিখেছিলেন ‘দেশে বিদেশে’, উপাধ্যক্ষের করা বিরোধী দলনেতার প্রতি মহান মন্তব্য শুনেই কি সমরেশ বাবু ‘গর্ভধারিণী’ লিখেছিলেন! সুব্রতবাবুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রশংসা করেই শীর্ষেন্দু বাবু ‘দূরবীণ’ রচনা করেছিলেন! পরিবহনের বর্তমান অবস্থা দেখেই কি শরৎচন্দ্র ‘দেবদাস’ লিখেছিলেন! নন্দীগ্রাম তদন্ত, ত্রিফলার রহস্য উদ্‌ঘাটন, টেট কেলেঙ্কারি, মহান সারদার তদন্ত এইরকম নানান ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই কি ফেলুদার চরিত্রের সৃষ্টি করেন!


কৌতূহল থাকা ভালো, তবে তার একটা সীমা থাকা দরকার’’--- উত্তমবাবু বলেছিলেন ‘হারানো সুর’ সিনেমাতে। তাই বলি পিসি আমার এই কৌতূহলের জন্য আবার মাওবাদী তকমা দিও না যেন!!!

No comments:

Post a Comment