স্বর্গের দেবতাদের কাছে দেবাদিদেব মহাদেবের জরুরী তলব
গিয়েছে অবিলম্বে কৈলাসে আসার জন্য। সব দেবতারা হাজির হবার পর মহাদেব বললেন- ‘‘আজ
আমরা ঘোর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। মর্তে কেউ আর আমাদের পূজা করছে না। সবাই এখন ৫৬ফুট
সততার মূর্তির পূজায় ব্যস্ত। জনসাধারণকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে ঐ নারী ও তাঁর
সাঙ্গপাঙ্গ। তাই মানুষের মোহ কাটাতে আমাদের অবিলম্বে কিছু একটা করতে হবে।’’ দীর্ঘ
আলাপ-আলোচনার পর নারায়ণ সিদ্ধান্ত জানালেন – ‘‘আমরা ঠিক করেছি, সততার পর্দা এবার উন্মোচন
করবোই। তাই নারদকে আমরা মর্তে স্টিং অপারেশনের জন্য পাঠাচ্ছি।’’
ব্রহ্মান্ডের প্রথম সাংবাদিক নারদ তো এই প্রাইম
অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যারপরনাই উৎফুল্ল। এমনিতেই লোকের হাঁড়ির খবর নেওয়া তাঁর
চিরকালের অভ্যেস। শুধু খবর নেওয়াই নয়, সেই খবর অন্য লোকের কাছে চালান করা বা কান
ভাঙানোতেও তিনি রীতিমত সুনাম(!) কুড়িয়েছেন। এবারও তিনি কামাল করে দেওয়ার লক্ষ্যে অল্প
সময়ের মধ্যেই যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। অতঃপর বাহন ঢেঁকিতে চড়ে তিনি স্বর্গলোক
থেকে মর্তে রওনা হলেন তাঁর স্টিং অপারেশনের লক্ষ্যে। সবার প্রথমেই গেলেন সততার পালের
অন্যতম গোদা নকুলের বাড়িতে। সাতসকালে গিয়ে দরজার বেল বাজালেন। দরজা খুলতেই বাতাসে
সন্দেহজনক শিউলির গন্ধ পেলেন। একটু ইতিউতি ভালো করে দেখে নিয়ে তবে নকুলের ঘরে ঢুকলেন।
নকুল তো নারদকে দেখে বেজায় খুশি। কারণ, নারদ যখনই আসেন, তখন এটা ওটা সঙ্গে নিয়ে
আসেন।
কথাবার্তা এরকম এগোতে থাকলো:
নারদ = ভাই নকুল, স্বর্গে তো আর ব্যবসা তেমন চলছে না। তাই
ভাবছিলাম, তোমাদের বাংলায় যদি একটু আমাকে ব্যবসা করতে দাও!
নকুল = অবশ্যই করতে দেব। আমাদের দিদির অনুপ্রেরণায় তো আমরা
সব ব্যবসায়ীকেই সব ব্যবসা করার সমস্ত রকম ছাড়পত্র দিচ্ছি। তা কী ব্যবসা করবেন,
দাদা? চিট ফান্ড!
ওটার কিন্তু এখানে হেব্বি ডিমান্ড। তবে ওটার রেট অনেক বেশি।
নারদ = আরে না না। আমার অতো পুঁজি নেই ভাই।
নকুল = তাহলে বোমা শিল্প করুন। সামনেই ভোট, তাই বাজার খুব
গরম। তাছাড়া সারা বছর আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই, মানে বিভিন্ন গোষ্ঠী সামলানোর জন্য
ওটার ডিমান্ড প্রচুর।
নারদ = আমি ভাবছিলুম একটা ল্যাংচা হাব বানাবো।
ইমপেক্স ল্যাংচা হাব। তাই যদি একটু ব্যাপারটা দেখ!
মানে জমি সমস্যা তো আছেই....
নকুল = ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব সাল্টে নেব। তবে ২০
লাখ দিতে হবে।
নারদ = সেকি, একেবারে ২০ লাখ!!!!
নকুল = হ্যাঁ। আমার ২০ লাখ, আর বাকিদের ৫লাখ করে দিলেই হবে।
আসলে আমারটার মধ্যে সততা দেবীর ভাগটাও ধরা আছে তো! আর একটা কথা, সততা দেবীর মতই
আমিও নিজের হাতে এখন টাকা নিই না। তাছাড়া এখন একটু সি বি আই, আর এনফোর্সমেন্ট
ব্রাঞ্চের চাপে আছি।
নারদ= হ্যাঁ, আমি কিছু কিছু শুনেছি।
নকুল= সেই জন্য টাকাটা আপনি আমার বিশ্বস্ত দালাল মীরজাফরকে
দিয়ে দিন। বাকি কথা পরে আমার এলগিন রোডের অফিসে আসুন, ওখানেই হবে। আজ আমি একটু
ব্যস্ত আছি। কথা পাক্কা হয়ে রইলো। টাকাটা কিন্তু আজই দিয়ে দেবেন।
নকুলের বাড়ি থেকে ঢেঁকি চড়ে নারদ চললেন বর্ধমানে মীরজাফরের
বাড়িতে। মীরজাফর আগেই নকুলের হোয়াটস্অ্যাপ্ মেসেজ পেয়ে গিয়েছিল। তাই সে নারদকে খুশি
মনেই স্বাগত জানালো। তাছাড়া, সকালবেলাতেই আমদানি কার না ভালো লাগে!
মীরজাফর = আরে নারদ ভাইসাব, আসুন, আসুন! আমি সুবাসাম এতো
আল্লাকে ডাকি তবুও তাঁর দেখা মেলে না। আর আপনাকে না ডাকতেই আপনি চলে এলেন।
নারদ = আসলে নকুলবাবু আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।
মীরজাফর = হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। ওঁর সাথে কথা হয়েছে। আসলে
লেনদেনটা আমিই ডিল করি তো। তবে আমার ৫লাখ কিন্তু আলাদা।
নারদ= সে আমি জানি! এক্সট্রাটা সঙ্গেই এনেছি। পুরো পঁচিশ
লাখ আছে।
মীরজাফরকে টাকা মিটিয়ে নারদ চললেন বিখ্যাত কবি হাকিমের বাড়ি।
তিনি বর্তমানে সততার ঘনিষ্ঠতম সাঙাৎদের একজন। নকুলের থেকেও তাঁকেই এখন বেশি ভরসা
করেন তিনি।
জাহাজপাড়ায় হাকিমের বাড়ি পৌঁছে গেলেন জলদি। বাড়ি তো নয়,
প্যালেস একটা! নিজের চেম্বারের রিভলভিং চেয়ারে খোলামেলা অবস্থায় দোল খাচ্ছিলেন
হাকিম...
নারদ = আসলে হাকিম সাহেব, আমি বাংলায় একটা ল্যাংচা হাব
খুলতে চাই, আপনি যদি
একটু সাহায্য করেন আর কি!!
হাকিম = কেন করবো না! উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নিশ্চয়ই
করবো। তবে প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না! ৫লাখের একটা টাকাও
কম আমি নিই না।
নারদ = ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাই হবে। তবে পরে কোনো সমস্যা হবে
না তো!
হাকিম = আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আর হ্যাঁ, টাকাটা নীচে আমার
লোক আছে, ওকে দিয়ে দিন। পরে গুনে নেবো।
নারদ নিচে গিয়ে হাকিমের লোকের হাতে টাকা তুলে দিলেন। ছেলেটা
একটু ফচ্কে টাইপের। নারদ কোথায় থাকেন জানতে চাইছিল। কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন তিনি।
নারদ তারপর চললেন অশোভন বাবুর অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখলেন
অশোভন বাবু এসি চালিয়ে বন্ধ কেবিনে দিব্যি সিগারেট টানছেন---
নারদ = অশোভন বাবু, আমার ল্যাংচাটা যদি একটু দেখেন!
অশোভন = নিশ্চয়ই দেখব। তবে তার আগে আপনি আমার ল্যাংচাটা দেখুন! রসেবশে না থাকলে তো শুকিয়ে লাট হয়ে
যাচ্ছে মাইরি!
নারদ = এই নিন, রসের জোগান দিয়ে দিলাম। ভালো করে গার্টার
লাগিয়ে দিয়েছি। যাতে পড়ে না যায়!
অশোভন = আমি এই সততার শালে মুড়ে রেখে দিলুম, এবার আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আরে, আমিই আপনাকে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। মাসখানেক বাদে আসুন। তবে আসার সময়
কিছু নিয়ে আসবেন। বুঝতেই তো পারছেন!
দেঁতো হাসি হেসে নারদ রওনা নেক্সট্ টারগেটের দিকে।
নারদের পরবর্তী গন্তব্য দক্ষিণ কলকাতায় তরমুজের বাড়ি। তরমুজ
নারদের পুরনো খদ্দের, বহুদিনের আলাপ। একসময় লাল-নীল জল ছাড়া তাঁদের দোস্তি জমতো
না। তবে এবারে স্টিং অপারেশনের চাপ। তাই তরমুজের সাথে সিঙাড়া-টিঙারা খেয়ে খোশমেজাজে
গল্প-গাছা করে, তাঁকে তাঁর
পাওনা মিটিয়ে দিয়ে খুশি করলেন। পরে ঝড়ের গতিতে একে একে বাকি কাজ সারলেন নারদ। শেফালির
ক্লায়েন্ট চিনতে প্রথমে একটু অসুবিধা হয়েছিল বটে, কিন্তু পরে ৫লাখ পেয়ে আনন্দে মন
ভরে যায়। অধ্যাপকবাবু এতোগুলো টাকা হাতে পেয়ে হিপনোটাইজ্ হয়ে গেলেন। রসুনবাবু টাকা
হাতে পেয়ে ওডাফার থেকেও বেশি খুশি হলেন। যেন আই এস এল নয়, ইংলিশ
প্রিমিয়ার লিগে খেলার চান্স পেয়ে গেছেন। আর মাতালটা তো নেশায় চুর হয়ে আছে। উঠে
টাকা নেবে সে ক্ষমতাও নেই।
নবাব আর তাঁর ভাইসাহেবও টাকা পেয়ে খুবই খুশি। সবাই নারদকে
সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
সফলভাবে স্টিং অপারেশন সমাপ্ত করার পর নারদ কৈলাসে ফিরে
গেলেন। সততার টিমের প্রায় গোটাটাই তিনি ৫২ঘন্টা ফুটেজে ধরে ফেলেছেন। তাতে পর্দা তুলতে কোনো অসুবিধা হবে না। কৈলাসে তখন সমস্ত দেবতারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে সবাই তো অবাক! তাহলে সততার টিমের এটাই আসল চেহারা! মহাদেব নন্দী-ভৃঙ্গীকে অর্ডার দিলেন-‘‘এখুনি নেট চালাও, ওয়াই-ফাই অন করো। ইউ টিউবে ভিডিওটাকে আপলোড
করে দাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা যেন ভাইরাল হয়’’। মহাদেবের আদেশ পেয়ে নন্দী-ভৃঙ্গী তুরন্ত ভিডিও আপলোড করে দিলেন। তক্ষুনি সমস্ত দেবতাই প্রায় একসঙ্গে ফেসবুকে শেয়ার করলেন ভিডিওটা। মূহুর্তে
মর্তলোকে হই হই রব পড়ে গেলো। সততা দেবী তখন কৈলাস পাহাড়ের কোলেই একটা অনুষ্ঠানে
ব্যস্ত ছিলেন। তাই তাঁর চিৎকারই সবচেয়ে
জোরে ভেসে আসতে লাগলো– ‘‘ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র। কুৎসা, কুৎসা, কুৎসা’’।
মহাদেব মুচকি এসে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বললেন – ‘‘ঐ দেখ! চোরের
মায়ের বড়ো গলা।’’
No comments:
Post a Comment