ভবানীপুরের চক্রবর্তীপাড়ার মদন চক্কোত্তি এলাকার স্বনামধন্য
বামুনঠাকুর। যজমান প্রচুর, বাড়িতে
দু’বেলা যজমানবাড়ি থেকে ডালা আসা(আজকাল প্যাকেটেও আসে) লেগেই আছে, এলাহি কারবার। শিষ্য-চ্যালা-চামুন্ডাও
বিস্তর। এমনিতে তাই তার আর্থিক অবস্থা নেহাত মন্দ ছিল না। এই তো অল্পদিন আগে ছেলের বিয়েতে ধাপার
মাঠে প্যান্ডেল করে সাত গ্রামের সমস্ত লোককে ভুরিভোজ করালেন। তা প্রায় হাজার দশেক
লোকের নেমন্তন্ন ছিল। নিন্দুকেরা বলে এই মন্দার বাজারেও নাকি আড়াই হাজার টাকা পার-প্লেট!
যজমানদের ঘাড় ভেঙে এমন ফোতোবাবুগিরি মদন চক্কোত্তির কাছে কোনো ব্যাপারই না! এই
শিল্পটা তিনি ছোটোবেলা থেকেই রপ্ত করেছেন।
বছরখানেক হলো নাকি চটা সুদের ব্যবসা ধরেছিলেন মদনবাবু। লোকে
টাকাও দিতেন নিশ্চিন্তে, হাজার
হোক পুরুত ঠাকুর বলে কথা। ধার্মিক মানুষ। উনি কি আর টাকা মারবেন! সাত গ্রামের
সমস্ত লোকের কাছ থেকেই নাকি তিনি বিন্দু বিন্দু করে কিস্তির টাকা আদায় করতেন। কিন্তু গত এক
বছরের বেশি হলো চক্কোত্তিমশাই শয্যাশায়ী। কি যে রোগ বাঁধলো, হাজার বদ্যিতেও তা ধরে
উঠতে পারছে না। চক্কোত্তিমশাই-এর প্রিয় পালঙ্কও আজ অসহ্য হয়ে উঠেছে। পালঙ্কের কাঠে কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে (উডবার্ণ)! শয্যাকন্টকী আর কি!
এমনিতে পাঁচবাড়ির পাঁচরকম প্রসাদ তো চক্কোত্তিমশাই-এর চারবেলা পেটে পড়তই। আর ঐ প্রসাদের কাটা ফল দিয়ে এক-দুপেগ
চোলাই টানাটা তার নিত্যকর্ম পদ্ধতির মধ্যেই ছিল। তবে কি সেই চোলাই খেয়েই কি পেটের
ব্যামো বাঁধালেন! বদ্যি আসে, বদ্যি যায়! কিন্তু চক্কোত্তিমশাই-এর উন্নতির কোনো
লক্ষণই নেই। বদ্যির পেছনে খরচও বাড়ছে দিনের পর দিন। গ্রামের পথে ঘাটে লোক মুখে
প্রায় এখন ফিসফাস শোনা যায় – ‘‘জটিল ব্যামোয় ধরেছে মশায়, সেকি আর অতো সহজে ছাড়বে!!’’
আত্মীয়রা ধীরে ধীরে প্রায় সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আগে
সবাই দুবেলা চক্কোত্তিবাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে খেতেন, হইহল্লা করতেন। এখন কেউ ভুলেও দেখা করতে আসেন না।
পাছে গ্রামের পাওনাদারেরা টাকা চেয়ে বসে। নিজের সাধের কাজলাদিদি, যে ওকে মায়ের মতন
স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, সব সময়
খোঁজ নিতেন, একেবারে
ভাই-অন্ত প্রাণ, সেই
কাজলাদিদিও আর খোঁজ নেয় বলে মনে হয় না। চক্কোত্তিমশাইয়ের স্ত্রী আবার সারদা মায়ের
ভক্ত। পাড়ার বৌ-ঝিদের কাছে তিনিই বলেছেন, মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে চক্কোত্তিমশাই নাকি
চিৎকার করেন, ‘‘বেইমান, বেইমান, সব শালা বেইমান!’’
কিছুদিন আগে রোগ সারাতে বিদেশ থেকে নামকরা এক বদ্যি
এনেছিলেন কাজলাদিদি, নাম তার
কপিল মহারাজ। আয়ুর্বেদিক মতে নাকি চিকিৎসা করেন। ওনার নাকি ‘হাত’-যশ প্রচুর। উনি
নাকি দুদিনেই অসুখ সারিয়ে দেবেন। কপিল মহারাজ সব কিছু দেখে ঔষধ তৈরি করলেন। নানান
গাছ-গাছড়ার শিকড়, ছাল, কিছু কয়লার গুঁড়ো হামানদিস্তেয় ফেলে পিষলেন। তারপর ঔষধে তিনি তার দু’নয়নের দিব্যদৃষ্টি
(টুজি স্পেকট্রাম) দিলেন। ঔষধ খাওয়ানো হলো। সবাই অধীর আগ্রহে বসে কি হয়, কি হয়! কিন্তু না, হলো না!! মহারাজের দিব্য ঔষধে কাজ দিল না। মহারাজ ফেরত চলে গেলেন। তবে লক্ষাধিক
টাকা দক্ষিণা নিয়ে। উপরন্তু মহারাজের পক্ষীরাজে গমনাগমন, সঙ্গে দুদিন বাঁড়ুজ্জেদের বাগানবাড়িতে থাকা ও সেবাখরচ বাবদ আরও কয়েক লক্ষ টাকা খরচ। সব খরচাই মেটানো
হলো গ্রামের মানুষের কাছে থেকে সেই বিন্দু বিন্দু করে জমানো টাকা থেকে।
মাঝে ত্রিফলার জল খেয়ে দিন দুই বেশ ভালোই সুস্থ হয়ে উঠছিলেন চক্কোত্তিমশাই।
তবে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। যদি আবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন! তাই চক্কোত্তিমশাই
ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতেন। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উদাস মনে তাকিয়ে
থাকতেন। কখনো কখনো অ্যাটেনডেন্ট পিয়ালীর সাথে গল্প করে দুটো মনের জমানো ব্যথার
কথা বলে হালকা হতেন। মিউজিক সিস্টেমে সকাল সন্ধ্যা হরিনাম সংকীর্তন শুনতেন। কিন্তু
ত্রিফলার জলে তো আর এই জটিল রোগ সারে না! সাময়িক উপশম মাত্র। তাই আবার চক্কোত্তিমশাই
বিছানা নিলেন।
এই অসুস্থ অবস্থাতেও চক্কোত্তিমশাই-এর প্রবল ইচ্ছে শেষবারের
মতন পাড়ার পুরোহিত অ্যাসোসিয়েসানের সভাপতি পদের জন্য ভোট লড়বেন। তিনি একথা কাজলাদিদিকেও
জানিয়েছেন। কাজলাদিদি তার ভাইয়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে এই আবদারে আর না করেননি।
যদিও কাজলাদিদির এই সিদ্ধান্তে পাড়ার লোক তো বটেই, এমনকি নিকটাত্মীয়রাও অবাক হয়েছেন। তবে কাজলাদিদির
মুখের ওপর কথা বলার সাধ্যি আছে কার! তবে পাড়ার পাওনাদারদের সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়!
তারা এও জানেন যে চক্কোত্তিমশাই যে টাকা তাদের কাছ থেকে মেরে দিয়েছেন, তা তো চক্কোত্তিমশাই
টাকা একলা আত্মসাৎ করেননি। সেই টাকায় ফুর্তি করেছেন চক্কোত্তিমশাই-এর নিকটাত্মীয়রাও।
আর কাজলাদিদি! উনিই বা কম কী সে! সবচেয়ে বেশি টাকা তো তার কব্জাতেই গেছে। গ্রামের এই প্রতারিত লোকগুলি
চক্কোত্তিমশাইকে আদৌ ভোট দেবে বলে মনে হয় না। এখন সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, চক্কোত্তিমশাই
দাঁড়াচ্ছেন তো বটে, কিন্তু আদৌ কী ভোটে জিততে পারবেন!
তবে চক্কোত্তিমশাই কিন্তু এতে দারুণ খুশি। আর সেই খুশিতেই
গদ গদ হয়ে চক্কোত্তিমশাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন ‘‘কাজলাদিদি আমাদের গেরামের জন্য যা
করেছেন, আগামী ১০০ বছরেও তা কেউ করতে
পারবেন না।’’
No comments:
Post a Comment