Tuesday 13 September 2016

পাগলা দাশু

                                      পাগলা দাশু 
রামপদ ধর্মঘটের দিন একহাঁড়ি বর্ধমানের মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল। আমরা সকলেই মহা উৎসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল দাশু। পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না,দুজনের মধ্যে প্রায়ই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলিত। আমরা রামপদকে বলিলাম, "দাশুকে কিছু দে।" রামপদ বলিল, "কি রে দাশু, খাবি নাকি ? দেখিস্‌, খাবার লোভ থাকে তো বল্‌ পরে আবার আমার নামে কুৎসা রটাস না!" এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তারপর দারোয়ানের ছাগলটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইতে খাওয়াইতে বলিল, "নাতি বর্ধমানের মিহিদানা এনেছে, ভালো করে খাও। হাবের জমিও চলে যাচ্ছে, পরের বছর কপালে নাও জুটতে পারে!" রামপদ তো রেগে আগুন। আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে হঠাৎ মনে পড়ল, রামপদর দাদুর নাম তো 'মদন'গোপাল। দাশু তারপর মুচকি মুচকি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল ।
পণ্ডিত মহাশয়, পার্থবাবু মানুষটি সুবিধার নহেন। নামেই উচ্চ শিক্ষিত, পিএইচডি ডিগ্রিটা পুরো জালি। তবে পড়ার জন্য কখনও কোনো তাড়াহুড়ো করেন না। সেই কবে একবার পরীক্ষা নিয়েছিলো তার রেজাল্ট আজও দিলেন না। একবার তো বাসে পরীক্ষার প্রশ্ন ওনার ঝোলা থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। রামপদ ওনার কোচিং এ পড়ে, ও বলে মোটা অনুদান দিলেই স্যার প্রশ্ন দিয়ে দেয়। এমনিতে শান্ত স্বভাবের তবে মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিক চটিয়া যান। সে সময়ে তাহার মেজাজটি আশ্চর্য রকম ধারাল হইয়া ওঠে। কেবল কুৎসা অপপ্রচার ষড়যন্ত্র বলে চেঁচামেচি করেন। দাশু বলে, এই রোগটা নাকি ওনার দিদিরও আছে।
পণ্ডিত মহাশয় চেয়ারে বসিয়াই সিলেবাসে নতুন যোগ হওয়া "সিঙ্গুর আন্দোলনের স্বার্থকতা আলোচনা কর" বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া হড়বড় করিয়া যা-তা খানিকটা বলিয়া গেলাম এবং তাহার উত্তরে, পণ্ডিত মহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্‌ঘড়্‌ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম, নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া 'কাটকুট' আর 'দশপঁচিশ' খেলা শুরু করিলাম । রামপদ আর নবিন চাঁদ দেখি হঠাৎ তর্কাতর্কি শুরু করে দিলো। নবীন বলে,"শিল্প হলে অনেক কর্ম সংস্থান হতো"। রামপদ বলে," নামটাই তো ন্যানো, মানে ছোটো কারখানা। তাতে আর কটা লোকের কাজ মিলবে!" নবীন বলে,"বেশীরভাগ লোকই তো জমি দিতে রাজি ছিলো।" নবীন বলে " কম সংখ্যক লোক অনিচ্ছুক মানে তারা সংখ্যায় লঘু। আর সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।" দাশু তর্কের মাঝখানে রামপদর দিকে তাকিয়ে একবার ফুট কাটলো "মাছওয়ালার কি করে ছাদ ফেলা পাকা বাড়ি হলো!" রামপদ কাঁচা খিস্তি দিতে গিয়েও থেমে গেলো। নবীন বলল, "আইনটা পুরনো এবং কিছুটা নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে বটে। তবে উদ্দেশ্য কিন্তু সত্ ছিলো।" রামপদ বুক ফুলিয়ে বলে,"রাজ্যে একজনই সত্।" বিতর্ক শুনে এটুকু বোঝা যাচ্ছিল , রামপদ পার্থবাবুর কোচিং-এ খুব মন দিয়ে টপিকটা পড়েছে।
সকলে ওদের তর্কাতর্কি শুনতে মত্ত, কেবল দাশু এক কোনায় বসিয়া কি যেন করিতেছে, সেদিকে আমাদের খেয়াল নাই । একটু বাদে পণ্ডিত মহাশয়ের চেয়ারের তলায় তক্তার নিচ হইতে ফট্‌ করিয়া কি একটাআওয়াজ হইল । পণ্ডিত মহাশয় " হার্মাদ হার্মাদ" চেঁচাইয়া হাত পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙ্গাইয়া, একেবারে ক্লাসের মাঝখানে ধড়্‌ফড় করিয়া পড়িয়া গেলেন । মিনিট পাঁচেক ভয়ানক আওয়াজের পর যখন সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, "কিসের শব্দ হইয়াছিল দেখ ।" দারোয়ানজি একটা লম্বা বাঁশ দিয়া অতি সাবধানে আস্তে আস্তে, তক্তার নিচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল- রামপদর সেই হাঁড়িটা, তখনও তাহার মুখের কাছে একটুখানি মিহিদানা লাগিয়াছিল ।
পণ্ডিত মহাশয়ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, "এ হাঁড়িটা কার ?" রামপদ বলিল, "আজ্ঞে আমার।" আর কোথা যায়- অমনি দুই কানে দুই পাক! "হাঁড়িতে কি রেখেছিলি!" রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে, সে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিতেছে। এমন সময় দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিত মহাশয়কে দেখাইয়া বলিল,"এই দেখুন, আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শিক্ষক দিবসের অনুদানের ১০,০০০টাকার কে কতো ঝাড়বে তার হিসেব করছিল।" শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা, পণ্ডিত মহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন । তারপরদাশুর দিকে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, "চোপ্‌ রও, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম? গতকাল রাতে স্কুলে মশার কামড়ে ডেঙ্গুর ভয়ে ঘুমাতে পারিনি। তাই একটু চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।" দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, "তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?" পণ্ডিত মহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, "বটে ? ওরা সবখেলা কচ্ছিল ? আর তুমি কি কচ্ছিলে ?"দাশু অম্লানবদনে বলিল, "আমি পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম ।" শুনিয়াই সকলের চক্ষুস্থির ! পন্ডিত মশাই বলিলেন,"তুমি জানো, স্কুলে পটকা ফাটানো অবৈধ!" দাশু বলিল, "আমার পট্‌কা, রামপদর হাঁড়ি । যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। ব্যাস্‌ !"

No comments:

Post a Comment