Tuesday 21 February 2017

লালু

                                                                           লালু

তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ 'সিজিও' নামে এক জটিল (কমপ্লেক্স) রোগ দেখা দিলে। পরিবর্তনের সোনার বাংলাতেও সিজিওর নামে লোকের প‍্যানিক অ্যাটাক হতে লাগলো। কারোর সিজিও-র সংক্রমন হয়েছে শুনলে তার বাড়িতে হাঁড়ি পর্যন্ত চড়তো না। আসলে সে আর বাড়ি ফিরবে কিনা সে ব‍্যাপারে বাড়ির লোক নিশ্চিত ছিলো না! মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুষ্কর হতো। পাছে তারও ছোঁয়া লেগে যায়! কিন্তু সে সুদিনেও(!) আমাদের ওখানে একজন ছিলেন যাঁর কখনো আপত্তি ছিল না। গোপালখুড়ো তাঁর নাম, জীবনের 'অনুপ্রেরণা' ছিল মড়া-পোড়ানো। কারও প‍্যানিক হয়েছে শুনলে তিনি ডাক্তারের কাছে প্রত্যহ সংবাদ নিতেন। আশা নেই শুনলে খালি পায়ে গামছা কাঁধে তিনি 'ঘণ্টা খানেক'-এর আগেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন। আমরা জনকয়েকছিলাম তাঁর দামাল চ্যালা। মুখ ভার করে বলে যেতেন,— চাপ প্রচুর বেড়েছে! আগে কেবল উডবার্ণে খোঁজ নিলেই চলতো, এখন আবার ভুবনেশ্বরেও ছুটতে হচ্ছে। ওরে,আজকের উনি প্রেস-মিটে কার কার নাম বলে মন দিয়ে শুনিস! আমাদের দলের মধ্যে ছিল লালুও একজন। ১০০ দিনের কাজে বাইরে না গেলে সে কখনো না বলত না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বিষণ্ণমুখে খুড়ো এসে বললেন, ব‍্যানার্জী পরিবারটা বুঝি রক্ষে পেলে না! সবাই চমকে উঠলাম। 'সততার পোতিক' কার্তিক বাবুর দিদি, টালির ঘরে কোনো মতে এসি লাগিয়েছিলেন। ছবি এঁকে আর কবিতা লিখে নীল-সাদা জীবন কাটছিলো। তার কিনা সিজিও-র ছোঁয়া লাগলো! একমাত্র অসুস্থ ভাইপো যে পিসির প্রতি একান্ত নির্ভরশীল। এই গোষ্ঠীদ্বন্দের জগতে আপন বলে তার আর কেউ রইল না! সে যেন আজ মাতৃহারা! রাত্রি আন্দাজ আটটা, পিসিকে আমরা ঘর থেকে উঠানে নামালাম। ভাইপো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। পিসি চলে যাবার দুঃখে কাঁদবেন! নাকি ক্ষমতা থেকে সম্পত্তি, সব নিজের হওয়ার আনন্দে পাগলু ডান্স করবেন! মৃতদেহ তোলবার সময় ভাইপো বললেন— নিয়ে যাবারসময় পিসির পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরিয়ে দিবিনে লালু?
গঙ্গার তীরে লালু খাট ছুঁয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসল। গঙ্গায় তখন উন্নয়নের জোয়ারে জলে ঢেউ উঠেছে, তার কোন-কোনটা লালুর পায়ের প্রায় নীচে পর্যন্ত আছাড় খেয়ে-খেয়ে পড়ছে। শহরের উইলকিনসন কোম্পানি থেকে শ্মশানে চন্দন কাঠ আসে, কি জানি সে কতক্ষণে পৌঁছবে। আধ-ক্রোশ দূরে পথের ধারে ডোমদের বাড়ি; আসার সময়ে আমরা তাদের হাঁক দিয়ে এসেছি, তবে আসবে বলে মনহয় না! এক সপ্তাহ ধরে চলা 'পিন্ডি উৎসব' গতকাল সবে শেষ হলো। কাল রাতে মালও টেনেছে প্রচুর। সহসা গঙ্গার ওপারে দিগন্তে একটা গাঢ় কালো মেঘ উঠে প্রবল উত্তরে হাওয়ায় হু হু করে সেটা এপারে ছুটে আসতে লাগল। ভাবতে-ভাবতেই মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে এলো। দিদি রইল পড়ে, প্রাণ বাঁচাতে কে যে কোথায় ছুট দিলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
জল থামলে 'ঘণ্টা-খানেক' পরে একে একে সবাই ফিরে এলাম। মেঘ গেছে কেটে, চাঁদের আলো ফুটেছে দিনের মত। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে পৌঁছেচে, গাড়োয়ান কাঠ এবং শবদাহের অন্যান্য উপকরণ নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবার উদ্যোগ করচে। কিন্তু ডোমদের দেখা নেই। গোপালখুড়ো বললেন, ও-ব্যাটারা ঐ রকম। প্রতিশ্রুতি দিয়ে কখনও না। মণি বললে, কিন্তু লালু এখনো ফিরলো না কেন? ভয়ে বাড়ি পালালো না ত? খুড়ো লালুর উদ্দেশে রাগ করে বললেন, ওটা মানসের জাত ভাই। যদি এতই ভয়, মড়া ছুঁয়ে বসতে গেলি কেন? আমি হলে সার্জিক‍্যাল স্টাইক হলেও মড়া ছেড়ে যেতাম না। ছেড়ে গেলে কি হয় খুড়ো? কি হয়? কত-কি?শ্মশানভূমি কিনা! শ্মশানে একলা বসে থাকতে আপনার ভয় করত না? ভয়! আমার? নন্দীগ্রামের সময় অন্ততঃ দশ হাজার মড়া পুড়িয়েছি জানিস! চিটফান্ড এজেন্ট থেকে আলুচাষির ঝুলে পড়া, বিষ খাওয়া হাজার খানেক বডি তো আছেই। নোট বাতিলের পর বেশ কিছু দাহ করেছি। গঙ্গাসাগরের ৯টা বডি থেকে ভাঙড়ে খুন হওয়া ২টো বডি, সব সতকার আমি নিজে হাতেই করেছি। এছাড়া সেভ ড্রাইভ সেভ লাইফের দু দশটা বডি তো রোজই পোড়াই।
এর পরে মণি আর কথা কইতে পারলে না। শ্মশানে গোটা-দুই কোদাল পড়েছিল, খুড়ো তার একটা তুলে নিয়ে বললেন, আমি চুলোটা কেটে ফেলি, তোরা হাতাহাতি করে কাঠগুলো নীচে নামিয়ে ফেল। খুড়ো চুলি কাটচেন, আমরা কাঠ নামিয়ে আনচি; নরু বললে, আচ্ছা, মড়াটা ফুলে যেন দুগুণ হয়েছে, না?খুড়ো কোনদিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন, ফুলবে না? ওনার মধ‍্যে কি কম 'পোতিভা' ছিলো! কবিতা, গান, ছবি আঁকা, গুন্ডা কন্ট্রোল করা। তাছাড়া উনি তো এখন অনশন মঞ্ছে শুয়ে নেই যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে!
কাঠ বহা প্রায় শেষ হয়ে এলো। নরুর দৃষ্টি ছিল বরাবর খাটের প্রতি। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে বললে,—খুড়ো, মড়া যেন নড়ে উঠল। খুড়োর হাতের কাজ শেষ হয়েছিল, কোদালটা ছুঁড়ে ফেলেদিয়ে বললেন, তোর সাথে মনেহয় সেলফি তুলতে চাইছে! গাধা কোথাকার! আবার মিনিট-দুই গেল। এবার মণি হঠাৎ চমকে উঠে পাঁচ-সাত পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে সভয়ে বললে, না খুড়ো, গতিক ভালো ঠেকছে না। সত্যিই মড়াটা যেন নড়ে উঠলো। খুড়ো এবারে হাঃ হাঃ—করে হেসে বললেন, ছোঁড়ার দল—তোরা ভয় দেখাবি আমাকে? যে ৩৪ বছর ধরে মড়া পোড়াচ্ছে—তাকে? নরু বললে, ঐ দেখুন আবার নড়চে।
খুড়ো বললেন, হাঁ নড়চে, ভূত হয়ে তোকে কিষেনজির মতন খুন করবে বলে—মুখের কথাটা তাঁর শেষ হলো না, অকস্মাৎ লেপকাঁথা জড়ানো মড়া হাঁটু গেড়ে খাটের উপর বসে ভয়ঙ্কর বিশ্রী খোনা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,— চক্কান্তো, ষড়যন্ত্র, কুৎসা, অপোপোচার, — ওরে বাবা রে! আমরা সবাই মারলাম ঊর্ধশ্বাসে দৌড়। গোপালখুড়ো পড়লেন গঙ্গার জলে। সেই কনকনে ঠাণ্ডা একবুক জলে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগলেন—বাবা গো, গেছি গো— খেয়ে ফেললে গো!—বাম—বাম—বাম—এদিকে সেই ভূতও তখন মুখের ঢাকা ফেলে দিয়ে চেঁচাতে লাগল—ওরে নির্মল, ওরে মণি, ওরে নরু, পালাস নে রে—আমি লালু—ফিরে আয়—ফিরে আয়!

No comments:

Post a Comment