Tuesday 28 February 2017

কৈলাসের কেলেঙ্কারি

                               কৈলাসের কেলেঙ্কারি 
ফেলুদা নিউজ চ‍্যানেল গুলো পাল্টে পাল্টে দেখছে। একটা ন‍্যাশান‍্যাল চ‍্যানেলে ব্রেকিং নিউজ বলে দেখাচ্ছে.... গুলমেহের দিল্লী ছাড়লেন, এমন সময় তোপসে এসে বলল, লালমোহন বাবু এসেছেন। ফেলুদা টিভিটা বন্ধ করে বলল, যাক হনুমান গুলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো! চল দ‍্যেখি, একসপ্তাহ পর এসেছেন। প্রশ্নের নিশ্চয়ই পাহাড় নিয়ে এসেছেন! বৈঠকখানার ঘরে ঢুকে ফেলুদা বলল, তা কি খবর! মশাইয়ের কোনো পাত্তা নেই যে! লালমোহন বাবু বললেন, এক সপ্তাহ পর মাকে অ্যাপেলো থেকে গতকাল বাড়িতে নিয়ে এলাম। ফেলুদা পকেট থেকে একটা চারমিনার বার করতে করতে বলল, পুরো টাকাটা পেমেন্ট করেছিলেন তো? লালমোহন বাবু জিভ কেটে বলল, কি যে বলেন!

তারপর লালমোহন বাবু কৌতূহল নিয়ে বললো, মিত্তির মশাইয়ের হাতে কি এখন কোনো কেস আছে? না মানে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি তো! তাই ভাবছিলুম যদি একটু পোল‍্যান্ড ঘুরে আসা যেত! তোপসে বলল - ফেলুদা সাবধান! পোল‍্যান্ডে যদি আবার প্লেন ল‍্যান্ড করতে দেরি হয় তাহলে কিন্তু লালমোহন বাবু 'চক্কান্ত, চক্কান্ত' বলে চিৎকার করতে পারে! ফেলুদা চানমিনারে একটা সুখটান দিয়ে অবশেষটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বলল, পরিবর্তনের বাংলায় কি কেসের অভাব আছে! কদিন ধরে উত্তরবঙ্গের শিশু পাচার কেসটা নিয়ে ভাবছি!

লালমোহন বাবু উত্তেজিত হয়ে বলল, অতো ভাবার কি আছে মশাই! এতো জলের মতন পরিস্কার! এই চক্রের সাথে মামাটির যোগ তো ত্রিফলার মতন জ্বলজ্বল করছে। তাছাড়া ঐ সঞ্চালক ছোকরা তো নিজে মুখেই স্বিকার করছে যে ও কার অনুপ্রেরণায় করেছে! তোপসে লালমোহন বাবুর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, সাবধান! ওমনভাবে আঙুল তুলে কথা বললে কিন্তু জয়াদি আঙুল কেটে নেবে!

ফেলুদা আরেকটা চারমিনার ধরিয়ে বলল- জুহি ম‍্যাডামের অন্তর্ধান রহস‍্য, নর্থ ব্লকে সান্ধ‍্য ভ্রমণ, এমনকি দ্রৌপদীও বস্ত্রদান করে কিছু একটা চাপা দিতে চেষ্টা করছে!গন্ধটা বড়ো সন্দেহজনক! লালমোহন বাবু বললেন দেশপ্রেমিকরা কোনো দিন শিশুপাচারের মতন জঘন‍্য কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারেনা! আনপসিবেল! ফেলুদা বলল, ISI স্ট‍্যাম্প মারা দেশপ্রেমিকরা কি কি পাচার করে সেটার তালিকা কৃশানুর কাছে পেয়ে যাবেন! আর কথাটা আনপসিবেল নয়! ইমপসিবেল। লালমোহন বাবু কিছুটা জিভ কেটে বললেন, মিসটেক! তাহলে রামভক্তরা এখন ঘেসো গুলোর শিশুপাচারের জোট সঙ্গী? জোট তো অনেকদিন ধরেই চলছে, না না অফিসিয়ালি কোথাও ঘোষনা করেনি! তবে মোষটা একবার হাম্বা করে সম্মতি জানিয়েছিল। লালমোহন বাবু ফেলুদার কথার ভাঁজ বুঝতে না পেরে করুনভাবে তোপসের দিকে তাকালো। তোপসে হেসে বলল, এটা টুইটের নতুন ট্রেন্ড।

বাইরে বারন্দায় রাখা পোষা চন্দনা পাখিটি অনেক্ষণ ধরেই বলে চলেছে, 'কৈলাসে কেলেঙ্কারি'। ফেলুদা প্রথমে ভেবেছিল কথাটি লালমোহন বাবুকে দেখে বলছে। আসলে কেউ কিছু বললে সেটা ও খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলে। এবারে অ্যাসট্রেটা ভরে গেছে বলে সিগারেটের অবশেষটা বাইরে ফেলতে বারান্দায় গিয়ে হঠাৎ খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো! মিনিট পাঁচেক মন দিয়ে চন্দনার বুলি শুনলো! তারপর মনেমনে হাসতে লাগলো! দেরি হচ্ছে দেখে তোপসে আর লালমোহন বাবু দুজনে বারান্দায় হাজির হয়ে দেখলো, ফেলুদা খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পাখিটাকে ছোলা খাওয়াচ্ছে। কাছে যেতেই ফেলুদা বলল, চন্দনা কি বলছে শুনুন! এবারে পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল চন্দনার বুলি... ' কৈলাসের কেলেঙ্কারি'

Wednesday 22 February 2017

অভিমানী মদন

                                      অভিমানী মদন

পাঁচ নম্বর বোতলটা শেষ হবার পর যখন ছ নম্বর বাংলার বোতলটা হারু খুললো, ততক্ষণে চাট শেষ। হারু কিন্তু কিন্তু করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল! তার আগেই মদন বলল, চাট শেষ তো কি হয়েছে! তুই ঢাল, আজ চাট ছাড়াই খাবো।

সকাল থেকেই আজ দাদার মুডটা অফ। সকালবেলায় দাদা হোয়াস অ্যাপে জেনেছে সিঙ্গুরের সোনালী ইতিহাস থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তখন অবশ‍্য ব‍্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি! কেবলই মনে হয়েছে, দিদি এমন কাজ করতেই পারে না। তবে মনের মধ‍্যে একটু খচখচানি ছিল! তাই নাতি স্কুল থেকে ফিরতেই ইতিহাস বইটা খুলে দেখে দাদার চোখ স্থির, গাল হাঁ! বাড়ির সবাই ছুটে এলো, ভেবেছে আবার প‍্যানিক অ্যাটাক হয়েছে বুঝি! দাদার গাল হাঁ! এমনিতে দাদা দিনে দুবার মুখ খোলে, খেতে আর খিস্তি দিতে। ছেলে তো ফোন করে উডবার্ণের বেড বুক করে ফেলল। প্রায় দশ মিনিট পর দাদা করুনভাবে বলল, আমি বাদ!

অন‍্যদিনের মতন সন্ধ‍্যা থেকেই নয়! বিকাল থেকেই দাদা আজ 'অন' হয়ে গেছে। কালু আর হারু কাঁচা ছোলা, বাদাম ভাজা আর এক পেটি বাংলা নিয়ে দাদার ঘরে ঢুকেছে। আজ আর মিউজিক সিস্টেমে ভোজপুরি চলছে না! চলছে, 'ইয়ে দুনিয়া ইয়ে ম‍্যায়ফিল মেরে কাম কি নেহি'। দাদা অপলক দৃষ্টিতে সামনের দেওয়ালে টাঙানো পিয়ালীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা পেগ মেরে যাচ্ছেন। হারু কিছুট ভয় পেয়ে কালুকে বলল, গতিক ভালো না! দাদার যদি পার্থর মতন অবস্থা হয়! কালু দাদার অন‍্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে চট করে একটা পেগ মেরে গালে দুটো ছোলা ফেলে বলল, দাদার কুশপুতুল পোড়াবে কার এতো সাহস! হারু বলল, তোর নেশা হয়ে গেছে, আমি সাইকো পার্থর আত্মহত‍্যার কথা বলছিলুম!

দাদা কাঁদো কাঁদো গলায় পিয়ালীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, তুমি তো সব জানো! বলো আমি কিনা করেছি সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়! ওনার অনুপ্রেরণায় আইটির ছেলেটাকে মঞ্চের পেছনে নিয়ে গিয়ে 1,2,3 করিয়েছি। ওনার জন‍্য ১০কিমি দুর থেকে চকলেট কিনে এনেছি! সারারাত মশার কামড় খেয়ে মঞ্চে শুয়ে থেকেছি! হারু বলল, ভাগ‍্যিস সোয়াই-ফ্লু হয়ে যায়নি!

পরের পেগটা হাতে নিয়ে আবার ছবির দিকে তাকিয়ে দাদা বলল, সবার নাম আছে আর আমার নামটাই বাদ! হারু এবার কালুকে বলল, ওরে নুর ভাবিকে একবার ফোন কর! এদিকে দাদা বলেই চলেছে, আমাকে জেলে একদিনও দেখতে আসেনি, এমনকি জেল থেকে ছাড়া পাবার পর একবারও নবান্নে বা কালীঘাটে ডাকেনি তাও আমার এতো দুঃখ হয়নি! কালু বলল, দাদা এবারে বুঝেছি কেন তোমার নাম দেয়নি! তুমি জেল খেটেছো বলে। দাদা এবার ছবি থেকে চোখ সরিয়ে কালুর দিকে কটমট করে লাল চোখে তাকিয়ে বলল, জেল তো সাইকেল চোরও খেটেছে! কালু বললো, তুমি তো এখন পোভাবশালী নও তাই হয়তো বাদ দিয়েছে! হারু পাশেই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা জোরে চাটা মারলো কালুর মাথায়।

নারদের ভিডিও গোটা রাজ‍্য দেখলো, ছেলে ঢুকাতে গিয়ে একজন জেলে গেলো, আরেক জন বিনে পয়সায় দেখিয়ে দিলো আর আমার বেলায় যত দোষ! হারু বলল, দাদা আমি সিওর, চক্রান্ত করে দিদি নামটা বাদ দিয়েছে! কালু বলল, চক্কান্ত তো সিপেম করে! হারু বলল, চিন্তা করো না দাদা, তোমার ইতিহাস ঐ অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রছাত্রীরা বুঝবে না! তোমার ইতিহাস ডিগ্রিকোর্সে পড়ানো হবে। কালু জল ছাড়াই শেষ পেগটা মেরে গেঞ্জীর কলারটা টেনে মুখটা মুছে বলল, আমরা এই দাবীতে কাল থেকে অনশনে বসবো!

( বি.দ্র. - এটি একটি কাল্পনিক গল্প। বাস্তবের সাথে কোনো মিল নেই। থাকলে সেটা কাকতালীয় )

Tuesday 21 February 2017

টালির ঘরে কালির বাচ্চা ‘ছোটা হাল্ক’


যেদিন কালীঘাটের টালির ঘরে দেড় হাজার কেজির বাচ্চা এলো, সেদিন তো এলাকায় হই হই পড়ে গিয়েছিল! না, না, নিজের নয়! কালীপিসির এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাচ্চা। সবার মুখে একটাই কথা, 'এত্যো বড়ো বাচ্চা! সত্যি!' কেউ কেউ বললো, ‘এটা 'পরিবত্তন'-এর ফল।কেউ বললো 'কচি কেষ্টা', কেউ বা বললো ঐ 'কচি পাত্তো'। আবার পাড়ার কচিকাঁচাগুলো 'ছোটা ভীম' বলে ডাকতে লাগলো! ওদিকে চাষার ব্যাটা মুচকি হেসে বললো, ‘‘হুঁ, হুঁ, বাব্বা, ত্যাখনই বোলেছিলুম! আমার হাইব্রিড থিওরি মিথ্যে নয়!’’

পিসি কিছুটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললো, ‘‘আ মোলো যা! এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে বুঝিনে বাপু! একটা সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চার ওজন তো দেড় হাজার কিলোটন থুড়ি, দেড় হাজার কেজি হওয়াই উচিত! সিপেম-এর আমলে তো যত বাচ্চা হয়েছে সবই আন্ডার ওয়েট!’’ গাছ-পালা-বাড়িঘর-সেতু-ইট-পাথর-গরু-ছাগল, জগতের যাবতীয় জিনিসের নতুন করে নামকরণ আর নীল-সাদাকরণে কালীপিসির বেজায় আনন্দ! স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারেই নিজের নামাঞ্জলি বইটা বার করে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে পিসি বললো, ‘‘হলিউডের অনুপ্রেরণায় এই বাচ্চার নাম রাখলুম 'ছোটা হাল্ক'’’ সবাই হাততালি দিলো শুনে!

কিন্তু সমস্যা একটাই, কালীঘাটের ঐ টালির ছোট্টো ঘর দেড় হাজার কেজির ছোট্টো বাচ্চা থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়! অগত্যা কী আর করা, পিসি তার জন্য মিডল্যান্ড পার্কে সারদাখুড়োর ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করলো! আর সবাইকে সকাল-সন্ধ্যা একবার করে দেখতে যাওয়ার হুকুম দিলো। সোহ্‌রাব চাচাকে বাচ্চার ফলের দায়িত্ব দিলো। সোনালী মাসিকে আয়ার দায়িত্ব দিলো। ববি চাচার দায়িত্ব পড়লো ফ্ল্যাট থেকে সমস্ত ইঁদুর-ছুঁচো মেরে তাড়ানোর। আসলে সুদীপ আঙ্কেল অনেকদিন হলো ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়েছে। তবুও পিসির চিন্তার শেষ রইলো না! আসলে ঐ দিকটায় ইদানিং মশার উৎপাত বেড়েছে। যদি মশার কামড়ে আবার বাচ্চার সোয়াইন-ফ্লু হয়! শেষে ভেটেরনারী ডাক্তার নির্মল, কালীপিসিকে আশ্বস্থ করায় পিসি কিছুটা নিশ্চিত হলেন।

পাত্তো মামা আর কানন মামা পরেরদিন সকাল ১০টা নাগাদ এলো। সেদিন পাত্তো মামার প্রচুর কাজের চাপ, তাই এসেই পকেট থেকে অনুদানের লিস্ট বার করে একে একে এস এম এস পাঠাতে লাগলো। এদিকে ছোট্টো হাল্ক ততক্ষণে কানন মামার সাথে সুইমিং পুলে নেমে পড়েছে। দু’জনেরই জল খুব প্রিয়। ৩০মিনিট স্নান করার পর, সোনালী মাসি যখন গা মোছানোর গামছা নিয়ে এলো তখন বাচ্চাটি বলল, ‘‘আমি মামার তোয়ালেতেই গা মুছবো!’’ কানন এক গাল হেসে বলল, ‘‘সোন্টামনা!! এই বয়সেই বাচ্চার এতো তোয়ালে প্রেম! ভাবা যায়!’’

এদিকে সারা দুপুর কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পাত্তোর একটু তন্দ্রা লেগেছে, তার মধ্যেই কখন ছোট্টো হাল্ক ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা সেই অনুদানের লিস্টের কাগজটা মুড়ে চিবোতে লেগেছে। ঘরের ভিতর খুট্‌খাট্‌ শব্দে তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পর টেবিলের ওপর তাকিয়ে দ্যাখে তালিকাটা নেই! তারপর পাগলের মতন গোটা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে যখন পাত্তো কাগজটা বাচ্চার মুখের ভিতর আবিষ্কার করলো, ততক্ষণে তালিকার নাম আর ফোন নম্বরগুলোর দফারফা হয়ে গেছে। অগত্যা পাত্তো আন্দাজেই এস এম এস পাঠাতে শুরু করলো।
      
বিকালের দিকে সুব্রত মামা গরম গরম সিঙাড়া নিয়ে হাজির হলো! মুকুল মামা আর শিউলি মাসি আইনক্স থেকে 'রইস' দেখে ফেরার পথে একবার ঘুরে গেলো। রাতে মদন মামার থাকার ডিউটি পড়লো। মদন মামা তো সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই চাটসহ চারটে বাংলার বোতল নিয়ে হাজির। ৮টার দিকে হঠাৎ নুর আন্টি এসে হাজির। নুর আন্টি বাচ্চার গালটা টিপে লুলু ভুলুবলে আদর করেই পাশের রুমে মামাকে 'হুনু  লুলু' আদর করতে চলে গেল।

সকালবেলায় যখন অমিত দাদুকে নিয়ে কালীপিসি ফ্ল্যাটে ঢুকলো তখনও মদনার হ্যাংওভার কাটেনি। গোটা ঘর বাংলার ভরপুর গন্ধে ম ম করছে। পিসি তো রেগে কাঁই! ‘‘তোর স্বভাবটা পাল্টালোনা এখনও! ভেবেছিলাম শ্রীঘরে গিয়ে একটু হয়তো শুধরাবি! নাহ, তোকে এখন গঙ্গার ওপাড়ে তো দূরের কথা, এমনকি সিঙ্গুরের ইতিহাসেও রাখা যাবে না।’’

মদনা চলে যাওয়ার পর কালীপিসি ছোট্টো হাল্ককে নিয়ে একটু আদর করে, দুটো সেলফি তুলে পোস্ট করল। ছোট্টো হাল্ক তো ততক্ষণে অমিতদাদুর ধুতি ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে! কাছা দুএকবার খুলেও গেলো! ফেরার পথে কালীপিসিকে অমিতদাদু বলল, ‘‘এমন বাচ্চা যদি হতে থাকে তাহলে আমাদের সবুজ সাথীর সাইকেলগুলোর কি অবস্থা হবে!’’       

কালীপিসির কাজের লোক

                                   কালীপিসির কাজের লোক 
কালীপিসির বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। রান্না করা, বাসন মাজা, জামাকাপড় কাচা, বাজার করা, জল আনা, ঘর মোছা, প্রতিটা কাজের জন‍্য কম করে ১০জন করে কর্মচারী আছে। এত কর্মচারী থাকলে যা হয় আরকি, পিসির প্রায় গুলিয়ে যায় কাকে কোন কাজের জন‍্য রেখেছে! তাই পিসি নিজের সুবিধার জন‍্য কর্মচারীদের বিভিন্ন জেলায় ভাগ করে দেন। যেমন রান্নার সাথে যুক্ত লোকেদের নিয়ে 'খাদ‍্যসাথী' জেলা, বাড়ির আশেপাশ পরিষ্কার করে যারা তাদের নিয়ে 'নির্মল গ্রাম' জেলা, জল আনে যারা তাদের নিয়ে 'জল ধর জল ভরো' জেলা, বাগান পরিচর্যা করে যারা তাদের নিয়ে 'সবুজ সাথী' জেলা।
রান্নার ডিপার্টমেন্টে একজন সব্জি কাটে, একজন সব্জি ধুয়ে দেয়, একজন বাটনা বাটে, একজন মশলার যোগান দেয়, একজন ভাত বসায়, একজন ভাত টিপে দ‍্যাখে, একজন ফ‍্যান ঝাড়ে, আরে কেবল গ‍্যাস জ্বালানোর জন‍্য একজন আছে। তবে এদের মধ‍্যে একমাত্র রান্নার ঠাকুর 'জ‍্যোতি'ই ওনার খুব 'প্রিয়'। তাই ওর চাকরিটা পার্মানেন্ট, বাকি গুলো সব কন্ট্রাকচুয়াল। গেটের সামনে যে সিকিউরিটি গার্ডকে গ্রামবাসী এতদিন বুকে পুলিশের ব‍্যাচ লাগাতে দেখতো, সেও এখন ভলেন্টিয়ারের ব‍্যাচ ঝোলাচ্ছে। তবে পিসি কিন্তু গ্রামের সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলে আমি না থাকলে গ্রামে কর্মসংস্থানই হতো না!
কিন্তু পিসির বাড়িতে কাজ করার সমস‍্যা আছে। পাড়ার অন‍্য বাড়ির কাজের লোকেরা মাস মাইনে ছাড়াও আরও কতো সুযোগ সুবিধা পায়। প্রতিদিন যাতায়াতের খরচ, টিফিন খরচ, পুজো পার্বনে বোনাস, আরও কতো কি! কালীপিসি ওসব তো দুর, মাস মাইনেটাও সবসময় টাইম মতন দেয়না। কাজের লোকেরা কিছু বললেই ন‍্যাকা কান্না কেঁদে বলে, আমার বাবার ৩৪ বছরের দেনা! আমি অতো টাকা পাবো কোথায়! পিসি যে টাকা প্রতিমাসে পাড়ার চন্ডি মন্ডপের উৎসবে আর ক্লাবে মোচ্ছবে খরচ করে, তার থেকে কিছুটা যদি বাড়ির কর্মচারীদের পিছনে করতো! কর্মচারীরা পঞ্চায়েতে অভিযোগও করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। পঞ্চায়েত বলেছে, ওসব পিসি দিতেও পারে! আবার নাও পারে! সবই পিসির ইচ্ছা।
তবে পিসি মাইনে, সুযোগ সুবিধা না দিতে পারলেও ছুটি দিয়ে সেই ঘাটতি পুসিয়ে দেয়। এই যেমন গত দুগ্গা পুজোতে এক্সট্রা ছুটি, দিওয়ালির পর ভাই ফোঁটাতে চারদিন ছুটি, ড্রাইভার আত্মা রাম একাই বিহারী তো কি হয়েছে! ছট পুজোর ছুটি বাড়ির সব জেলাতেই ঘোষণা করলেন। বাজার করেন রসুল চাচা, তার জন‍্যই ফতেয়ায় সবার ছুটির ফতেয়া দিলেন পিসি। পাড়ার অন‍্য বাড়ির কাজের মহিলারা কেবল মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও, পিসির বাড়ির মহিলারা তো বটেই এমনকি পুরুষরাও পিতৃত্বকালীন ছুটি পায়। তবে পাড়ার অন‍্য বাড়ির কাজের লোকেরা যদি কোনো দাবীতে একদিন কর্ম বিরতির ডাক দেয় সেদিন কিন্তু পিসির বাড়ির কর্মচারীদের কামাই করা চলবে না। দরকারে পিসি অন‍্য একদিন ছুটি দিয়ে দেবে। আসলে পিসি বলে, অমন করলে নাকি কর্ম সংস্কৃতি নষ্ট হয়।
গতকাল যখন ভুটিয়া সিকিউরিটি গার্ডের জন‍্য বুদ্ধ পূর্ণিমাতে ছুটি ঘোষণা করল, তখন বাসন মাজতে মাজতে শান্তা বুড়ি বলল, শুধু পূর্ণিমা! আমি তো একাদশী করি।

হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন

                                                           হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন

হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন দুই ভাই, বর্ধন এন্ড বর্ধন কোম্পানির মালিক। ভুবনেশ্বরে তাদের বিশাল কাঠের ব্যাবসা। সারা দেশে তো বটেই, এমনকি বিদেশেও প্রচুর নাম ডাক তাদের। গতকাল রাতে হর্ষবর্ধন তার ভাইকে বলল - বুঝলি গোবরা, চল কদিন কোলকাতায় ঘুরে আসি। তাছাড়া কালীঘাট থেকে ম্যাডাম ফোন করেছিল। বলে দরকার আছে, তাড়াতাড়ি একবার দ্যাখা করো। শুনে গোবর্ধন বলল - মনেহয় ভাইপোর বিয়ের ফার্নিচারের অর্ডার দেবে! হর্ষবর্ধন বিরক্ত হয়ে বলল, তোর মাথায় সত্যিই গোবর আছে গোবরা। আরে গতকাল ধিমানসভায় যে ভাংচুর হয়েছে, তার অর্ডার। গোবরা দাঁত বার করে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছ। তাছাড়া অনেকদিন হলো কোথাও যাওয়া হয়নি, আর আমদের উপর তো কোর্টের নিযেধাজ্ঞা নেই যে ভুবনেশ্বরেই পড়ে থাকতে হবে! সিবিআই-ও আমাদের ‘পোভাবশালী’ তকমা দেয়নি। তাই যেতে তো অসুবিধা নেই।
পাক্কা আধা ঘন্টা বিমান আকাশে চক্কর কাটার পর ল্যান্ড করতে গোবরা বলল, যাক বাবা তাহলে ষড়যন্ত্র নয়। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি ছোটাছুটি করে, খান কুড়ি নীলসাদা ‘নো-রিফিউজাল’ লেখা ট্যাক্সি দ্বারা রিফিউজ হয়ে শেষে গোবরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ততক্ষণে দাদা তার জিও সিম লাগানো ফোন দিয়ে ওলা বুক করে ফেলেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি হাজির।
গাড়ি শহরে ঢোকার মুখেই জ্যামে পড়ল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানলো, সামনে তৃণমূলের মিছিল। তবে কিসের জন্য মিছিল সেটা জানার পর গোবরার গাল হাঁ! কিছুদূর যেতে ধর্ষনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ মিছিলও দেখা গেল। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার ধারে একটা জমায়েত চোখে পড়লো। স্টেজের পিছনের ব্যানারটা দ্যেখে হর্ষবর্ধন কেটে কেটে বলতে লাগল, ‘ভা ঙ ড় স ং হ তি ম ঞ্চ’। ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করাতে, এবারে ড্রাইভার হাঁ! বলেন কি! আপনারা কিছুই জানেন না! গোবরা বলল জানি তো! উদয়ন তেল মেখেছে, মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে, ঘন্টাখানেক ধরে চেষ্টা করে কষা হেগেছে!
লন্ডনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তারা নবান্নে পৌঁছে গেলো। নবান্নে গিয়ে ম‍্যাডামের কথা মতন মুখার্জী'দার সাথে দ‍্যাখা করতে দুই ভাই তার কেবিনে ঢুকলো। কি মুখার্জী বাবু, কেমন আছেন বলুন! মুখার্জী হর্ষবর্ধনকে দেখে একগাল হেসে বললেন, আরে আসুন আসুন! এই নিন কালিঘাটের সিঙাড়া খান, একদম গরম! এই বলে প্লেটে চারটে সিঙাড়া দিয়ে দুই ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। গোবর্ধন ইতস্তত করে বলল - দাদা, গোপন ক্যামেরা চালু থাকতে পারে কিন্তু! গোবরার কথায় হর্ষবর্ধনের মনে খটকা লাগলো! তাই হর্ষবর্ধন হেসে মুখার্জীকে বলল, গতবার আহারে বাংলায় সিঙাড়া খেয়ে আমার ডাইরিয়া হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সিঙাড়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গোবরাও তাল মেলাল, এক সপ্তাহ ধরে পায়খানা বমি জ্বর, ধর্ষনটা হতেহতে বেঁচে গিয়েছিল! অগত্যা মুখার্জী নিজেই চারটে সাবাড় করে দিয়ে বলল, চলুন এবারে তাহলে ধিমানসভায় যাওয়া যাক। আর হ্যাঁ, খরচটা ২% বাড়িয়ে বলবেন। ওটা আমার 'মিনিমাম' কমিশন। ঘর থেকে বেরানোর সময় গোবরা তার দাদাকে ফিসফিস করে বলল, এই লোকটা ধিমানসভায় ‘চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়’ চালিয়ে ঢুকেছিল না? হর্ষবর্ধন সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলল, দুবার চ্যাংদোলা করে ধিমানসভার বাইরে বার করে দেওয়া হয়েছিল।
ধিমানসভায় পৌঁছে দ্যাখে ম্যাডাম আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। দুই ভাইকে দেখে ম্যাডাম বললেন - আসুন আসুন, ভালো করে দেখুন। এগুলো মেরামত করতে কতো খরচ হতে পারে? গোটা বিধানসভা ভালো করে দেখার পর হর্ষবর্ধন বলল, ফার্নিচার তো তেমন কিছু ভাঙেনি! গতবার এরচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের মুখে এই কথা শুনে উনি রেগে বললেন, যে ফার্নিচার গুলোর গায়ে একটু আঁচড় লেগেছে সেগুলোকেও পাল্টাতে হবে। সব ফার্নিচার চন্দন কাঠের বানাবেন। কাঠ স্টকে কম থাকলে আমাদের উইলক্লিনসের কাছ থেকে নিয়ে নেবেন। গোবরা বলল, চন্দন কাঠের ফার্নিচার তো ভালো হয়না! ম্যাডাম রেগে গিয়ে বলল, আমাকে কাঠ চেনাচ্ছ ছোঁড়া! গোটা জঙ্গলমহল আমার চষা! আর হ্যাঁ, পেমেন্টটা বিরোধীদের কাছ থেকে নিও। আমার এমনিতেই ৩৪বছরের দেনা!
হর্ষবর্ধন কিন্তু কিন্তু করে বলল, গতবারের পেমেন্টা কিন্তু পুরো কথাটা শেষ হলো না উনি হঠাৎ বাজখাই গলায় চিৎকার করে উঠলেন, মার্শাল! এই মার্শাল! ইধার এসো, এই দুটাকে এক্ষুনি ঘাড় ধক্কা দে কে বাহার নিকালো।

লালু

                                                                           লালু

তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ 'সিজিও' নামে এক জটিল (কমপ্লেক্স) রোগ দেখা দিলে। পরিবর্তনের সোনার বাংলাতেও সিজিওর নামে লোকের প‍্যানিক অ্যাটাক হতে লাগলো। কারোর সিজিও-র সংক্রমন হয়েছে শুনলে তার বাড়িতে হাঁড়ি পর্যন্ত চড়তো না। আসলে সে আর বাড়ি ফিরবে কিনা সে ব‍্যাপারে বাড়ির লোক নিশ্চিত ছিলো না! মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুষ্কর হতো। পাছে তারও ছোঁয়া লেগে যায়! কিন্তু সে সুদিনেও(!) আমাদের ওখানে একজন ছিলেন যাঁর কখনো আপত্তি ছিল না। গোপালখুড়ো তাঁর নাম, জীবনের 'অনুপ্রেরণা' ছিল মড়া-পোড়ানো। কারও প‍্যানিক হয়েছে শুনলে তিনি ডাক্তারের কাছে প্রত্যহ সংবাদ নিতেন। আশা নেই শুনলে খালি পায়ে গামছা কাঁধে তিনি 'ঘণ্টা খানেক'-এর আগেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন। আমরা জনকয়েকছিলাম তাঁর দামাল চ্যালা। মুখ ভার করে বলে যেতেন,— চাপ প্রচুর বেড়েছে! আগে কেবল উডবার্ণে খোঁজ নিলেই চলতো, এখন আবার ভুবনেশ্বরেও ছুটতে হচ্ছে। ওরে,আজকের উনি প্রেস-মিটে কার কার নাম বলে মন দিয়ে শুনিস! আমাদের দলের মধ্যে ছিল লালুও একজন। ১০০ দিনের কাজে বাইরে না গেলে সে কখনো না বলত না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বিষণ্ণমুখে খুড়ো এসে বললেন, ব‍্যানার্জী পরিবারটা বুঝি রক্ষে পেলে না! সবাই চমকে উঠলাম। 'সততার পোতিক' কার্তিক বাবুর দিদি, টালির ঘরে কোনো মতে এসি লাগিয়েছিলেন। ছবি এঁকে আর কবিতা লিখে নীল-সাদা জীবন কাটছিলো। তার কিনা সিজিও-র ছোঁয়া লাগলো! একমাত্র অসুস্থ ভাইপো যে পিসির প্রতি একান্ত নির্ভরশীল। এই গোষ্ঠীদ্বন্দের জগতে আপন বলে তার আর কেউ রইল না! সে যেন আজ মাতৃহারা! রাত্রি আন্দাজ আটটা, পিসিকে আমরা ঘর থেকে উঠানে নামালাম। ভাইপো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। পিসি চলে যাবার দুঃখে কাঁদবেন! নাকি ক্ষমতা থেকে সম্পত্তি, সব নিজের হওয়ার আনন্দে পাগলু ডান্স করবেন! মৃতদেহ তোলবার সময় ভাইপো বললেন— নিয়ে যাবারসময় পিসির পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরিয়ে দিবিনে লালু?
গঙ্গার তীরে লালু খাট ছুঁয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসল। গঙ্গায় তখন উন্নয়নের জোয়ারে জলে ঢেউ উঠেছে, তার কোন-কোনটা লালুর পায়ের প্রায় নীচে পর্যন্ত আছাড় খেয়ে-খেয়ে পড়ছে। শহরের উইলকিনসন কোম্পানি থেকে শ্মশানে চন্দন কাঠ আসে, কি জানি সে কতক্ষণে পৌঁছবে। আধ-ক্রোশ দূরে পথের ধারে ডোমদের বাড়ি; আসার সময়ে আমরা তাদের হাঁক দিয়ে এসেছি, তবে আসবে বলে মনহয় না! এক সপ্তাহ ধরে চলা 'পিন্ডি উৎসব' গতকাল সবে শেষ হলো। কাল রাতে মালও টেনেছে প্রচুর। সহসা গঙ্গার ওপারে দিগন্তে একটা গাঢ় কালো মেঘ উঠে প্রবল উত্তরে হাওয়ায় হু হু করে সেটা এপারে ছুটে আসতে লাগল। ভাবতে-ভাবতেই মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে এলো। দিদি রইল পড়ে, প্রাণ বাঁচাতে কে যে কোথায় ছুট দিলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
জল থামলে 'ঘণ্টা-খানেক' পরে একে একে সবাই ফিরে এলাম। মেঘ গেছে কেটে, চাঁদের আলো ফুটেছে দিনের মত। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে পৌঁছেচে, গাড়োয়ান কাঠ এবং শবদাহের অন্যান্য উপকরণ নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবার উদ্যোগ করচে। কিন্তু ডোমদের দেখা নেই। গোপালখুড়ো বললেন, ও-ব্যাটারা ঐ রকম। প্রতিশ্রুতি দিয়ে কখনও না। মণি বললে, কিন্তু লালু এখনো ফিরলো না কেন? ভয়ে বাড়ি পালালো না ত? খুড়ো লালুর উদ্দেশে রাগ করে বললেন, ওটা মানসের জাত ভাই। যদি এতই ভয়, মড়া ছুঁয়ে বসতে গেলি কেন? আমি হলে সার্জিক‍্যাল স্টাইক হলেও মড়া ছেড়ে যেতাম না। ছেড়ে গেলে কি হয় খুড়ো? কি হয়? কত-কি?শ্মশানভূমি কিনা! শ্মশানে একলা বসে থাকতে আপনার ভয় করত না? ভয়! আমার? নন্দীগ্রামের সময় অন্ততঃ দশ হাজার মড়া পুড়িয়েছি জানিস! চিটফান্ড এজেন্ট থেকে আলুচাষির ঝুলে পড়া, বিষ খাওয়া হাজার খানেক বডি তো আছেই। নোট বাতিলের পর বেশ কিছু দাহ করেছি। গঙ্গাসাগরের ৯টা বডি থেকে ভাঙড়ে খুন হওয়া ২টো বডি, সব সতকার আমি নিজে হাতেই করেছি। এছাড়া সেভ ড্রাইভ সেভ লাইফের দু দশটা বডি তো রোজই পোড়াই।
এর পরে মণি আর কথা কইতে পারলে না। শ্মশানে গোটা-দুই কোদাল পড়েছিল, খুড়ো তার একটা তুলে নিয়ে বললেন, আমি চুলোটা কেটে ফেলি, তোরা হাতাহাতি করে কাঠগুলো নীচে নামিয়ে ফেল। খুড়ো চুলি কাটচেন, আমরা কাঠ নামিয়ে আনচি; নরু বললে, আচ্ছা, মড়াটা ফুলে যেন দুগুণ হয়েছে, না?খুড়ো কোনদিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন, ফুলবে না? ওনার মধ‍্যে কি কম 'পোতিভা' ছিলো! কবিতা, গান, ছবি আঁকা, গুন্ডা কন্ট্রোল করা। তাছাড়া উনি তো এখন অনশন মঞ্ছে শুয়ে নেই যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে!
কাঠ বহা প্রায় শেষ হয়ে এলো। নরুর দৃষ্টি ছিল বরাবর খাটের প্রতি। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে বললে,—খুড়ো, মড়া যেন নড়ে উঠল। খুড়োর হাতের কাজ শেষ হয়েছিল, কোদালটা ছুঁড়ে ফেলেদিয়ে বললেন, তোর সাথে মনেহয় সেলফি তুলতে চাইছে! গাধা কোথাকার! আবার মিনিট-দুই গেল। এবার মণি হঠাৎ চমকে উঠে পাঁচ-সাত পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে সভয়ে বললে, না খুড়ো, গতিক ভালো ঠেকছে না। সত্যিই মড়াটা যেন নড়ে উঠলো। খুড়ো এবারে হাঃ হাঃ—করে হেসে বললেন, ছোঁড়ার দল—তোরা ভয় দেখাবি আমাকে? যে ৩৪ বছর ধরে মড়া পোড়াচ্ছে—তাকে? নরু বললে, ঐ দেখুন আবার নড়চে।
খুড়ো বললেন, হাঁ নড়চে, ভূত হয়ে তোকে কিষেনজির মতন খুন করবে বলে—মুখের কথাটা তাঁর শেষ হলো না, অকস্মাৎ লেপকাঁথা জড়ানো মড়া হাঁটু গেড়ে খাটের উপর বসে ভয়ঙ্কর বিশ্রী খোনা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,— চক্কান্তো, ষড়যন্ত্র, কুৎসা, অপোপোচার, — ওরে বাবা রে! আমরা সবাই মারলাম ঊর্ধশ্বাসে দৌড়। গোপালখুড়ো পড়লেন গঙ্গার জলে। সেই কনকনে ঠাণ্ডা একবুক জলে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগলেন—বাবা গো, গেছি গো— খেয়ে ফেললে গো!—বাম—বাম—বাম—এদিকে সেই ভূতও তখন মুখের ঢাকা ফেলে দিয়ে চেঁচাতে লাগল—ওরে নির্মল, ওরে মণি, ওরে নরু, পালাস নে রে—আমি লালু—ফিরে আয়—ফিরে আয়!

দুই বৌদির ব‍্যক্তিগত কথপোকথন

                                                দুই বৌদির ব‍্যক্তিগত কথপোকথন
ময়না = (কেঁদে কেঁদে ) হ্যলো নন্দিনী, শুনেছিস তোর দীপ’দাকেও সিবিআই ঢুকিয়ে দিলো! শেষ রক্ষা করতে পারলুম না!
নন্দিনী = ( স্বামী জেলে সঙ্গী পেয়েছে সেই আনন্দ চেপে, দুখী দুখী ভাব করে ) হ‍্যাঁ, খবরে দেখলুম।
ময়না = ( ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ) তোর মতন আমিও সারাদিন সিজিওতে পড়েছিলুম। বীরের মতন সাতসকালে এসেছিল, শেষে টানতে টানতে নিয়ে গেলো।
নন্দিনী = কপাল দিদি, কপাল! শাশুড়ির ওপর অবিচারের ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। তা নাহলে সবাই খীর খেল, এমনকি ভিডিওতেও দেখা গেল, আর কেবল আমাদের দুজনের স্বামী ভিতরে ঢুকলো!
ময়না = শোন না, তুই তো ভালো রান্না করিস! তোর দীপ’দা পোস্ত খেতে খুব ভালোবাসে। তুই দু’দিন পোস্তোর বড়া আর আলুপোস্ত করে জেলে নিয়ে যাবি! উড়েদের জেলের রান্না যদি তোর দীপ'দা সহ্য করতে না পারে!
নন্দিনী = আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি কবে আসছো?
‌‌‌‌‌‌‌‌‌
ময়না = আরে আমার টিকিট কনফার্ম হলেই রওনা দেব। ‌

নন্দিনী = তুমি দেরি না করে দাদার সাইকেলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়ো!
মরনা = ধুস! সবুজসাথীর ঐ লক্কড় সাইকেল ভুবনেশ্বর পর্যন্ত আমার থোড়াই সাথ দেবে!
নন্দিনী = আরে না না! আমি বহরমপুরের সাইকেলের কথা বলছিলুম!
ময়না = না বাবা! ওটা ওর জীবনের প্রথম সাইকেল, যেতে যেতে যদি ভেঙে যায় তাহলে আর রক্ষে থাকবে না!
নন্দিনী = বলছি, মলন'দা জেলে থাকার কোনো টিপস দিলো?
ময়না = ও হ‍্যাঁ, বলতে ভুলেগেছি! মদনদা পই পই করে বারন করেছে প‍্যানিক অ্যাটাকের অভিনয় করতে। ওখানের হাসপাতালে কোনো উডবার্ন নেই!
নন্দিনী = আচ্ছা, রায় বৌদি'কে একবার ফোন করে সিবিআইয়ের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার টিপস চাইলে কেমন হয়!
ময়না = ধুস! উনি কিছুই জানেন না। গোকুল'দার ছাড়া পাওয়ার রহস‍্য একমাত্র শিউলি জানে।
নন্দিনী = তা দিদি আর কেউ ভুবনেশ্বরে আসছে? কিছু খবর পেলে?
ময়না = খবরে বলছিল জেলে নাকি এবারে বেদে আর তার মেয়ে জ্যোৎস্না আসছে!
নন্দিনী = বেদেকে নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা তো জ‍্যোৎনাকে নিয়ে৷ আমার 'মাল'টাকে তো আমি হাড়ে হাড়ে চিনি! জেলের ভিতরেই যদি ... তুমি দীপ'দাকে বোলো ওকে সচেতন করে দিতে। জেলের বাইরে হোক বা ভিতরে, দীপ'দাই তো মূখ‍্য সচেতক!
ময়না = আমাদের স্বামীদের জেল থেকে ছাড়ানোর কোনো গা নেই দিদির!
নন্দিনী = ঠিক বলেছ দিদি, তাও দীপ'দাকে ধরতে তবুও একটু নড়েচড়ে উঠেছে! আমার বরকে ধরার পর মনে হয়েছিল, সিবিআই চন্দননগরের মালকে না ধরে একটা পকেটমারকে ধরেছে!
ময়না = আর কি এমন নড়েচড়ে উঠল শুনি! ঐ একদিন এবিপির মতন ঘন্টাখানেক অবরোধ সঙ্গে একটা শিশু মৃত‍্যু। ব‍্যাস! খেল খতম!
ময়না = যা বলেছ দিদি! ছেলে গুলোকে কোথায় এখন সিজিওতে ঢোকাবে! না এখন কলেজে কলেজে এস এফ আই পেটাতে পাঠাচ্ছে!
নন্দিনী = দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে লোক হাসাতে হাজির হয়েছিল! ওটা একটা আন্দোলন!
ময়না = নামেই সুলতান, আর পুলিশের প‍্যাঁদানির ভয়ে পালাচ্ছে। আর ঐ নাট‍্যকার জাল গাড়ির ভিতর প্রেক্ষীত খুঁজে বেড়াচ্ছে! ঢং দেখলে গা পিত্তি জ্বলে যায়!
নন্দিনী = এক সপ্তাহ হতে গেলো, এখনও গোষ্টো পালের পায়ের নিচে অনশন মঞ্চের বাঁশ পর্যন্ত পড়ল না!
ময়না = মদনার বেলায় পুষ্প বৃষ্টি, অনশন, কতো আয়োজন! আর আমাদের বরেদের বেলায় ... চক্রান্ত কে করছে আমরা বুঝি না! যেদিন ভাইপোকে তুলে নিয়ে যাবে সেদিন দেখবি হাওয়াই চটি খুলে ছুটছে!
নন্দিনী = যা বলেছ দিদি। ঠিক ফোন করে সেটিং করে নেবে! তবে আজকে একটু আশার আলো দেখেছি। দিদি অনেকদিন পর সংখ‍্যালঘু ছেড়ে সংখ‍্যাগুরুদের প্রশংসা করেছেন। মনেহয় গাড়ি ঠিক লাইনেই যাচ্ছে। জয় জগন্নাথ।
( নেটওয়ার্ক প্রবলেম )
ময়না = ধুস! জিওর কানেক্সশানটা দিনে দিনে যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে! আচ্ছা শোন, আমি দুদিনের মধ‍্যেই যাচ্ছি। দাদার খেয়াল রাখিস! ওকে বাই!
( বি. দ্র. = বাস্তবের সাথে এই সংলাপের কোনো মিল থাকলে সেটা কাকতালীয় )