Friday 29 April 2016

পেরেকের ফোটোশপ


স্কুলে গরমের ছুটি পড়তেই ফেলুদা বললো, ‘‘চল তোপ্‌সে, অনেকদিন পাহাড়ে যাওয়া হয়নি। কদিন পাহাড়ে ঘুরে আসি।’’ বাবাও আপত্তি না করে বললো, ‘‘ভালোই তো! এই গরমে কোলকাতায় বসে বসে পচার কোন মানেই হয় না! তার চেয়ে বরং তোরা কদিন দার্জিলিং ঘুরে আয়।’’ ফেলুদা হেসে বললো, ‘‘সুইজারল্যান্ড ইজ ফার বেটার দ্যান লন্ডন।’’ আমি বললাম, ‘‘এর মধ্যে আবার সুইজারল্যান্ড-লন্ডন কোত্থেকে এলো!’’ আমার কথা শুনে বাবা আর ফেলুদা দু’জনেই হেসে উঠলেন। ফেলুদা বললো, ‘‘তুই লালমোহনবাবুকে এখুনি হোয়াটস্‌অ্যাপ্‌ করে দে, আজ রাতেই ১০.০৫-এ দার্জিলিং মেল। সময়মতন সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যেন শিয়ালদহ স্টেশনে চলে আসেন।’’

আমি আর ফেলুদা শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছি, রাত ৯.৪৫ নাগাদ দেখি লালমোহনবাবু একহাতে সুটকেশ, আর কাঁধে তাঁর প্রিয় ঝোলাটা নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে আসছেন। আমাদের কাছে এসেই সুটকেশটা রেখে তার ওপরেই বসে পড়লেন। ঝোলা থেকে জলের বোতলটা বার করে, ঢক ঢক করে পুরোটা শেষ করে ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘মশাই, কুলিগুলোকে কত করে বললাম সুটকেশটা নিতে, কেউ নিলো না! আমি দশ টাকা বেশি দেব বললাম, তাতে বলে কিনা, আমরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না!’’ ফেলুদা বললো, ‘‘চিন্তা করবেন না, মাননীয়া বলেছেন কিছুদিনের মধ্যেই ‘নো রিফিউজাল কুলি’ চালু হবে। চলুন এখন ট্রেনে ওঠা যাক।’’

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন নামলাম তখন সকাল ৭.৩০। দুটো কচুরি আর ল্যাংচা সহযোগে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জিপ এন.এইচ. ৩১এ ধরে সেবকের দিকে ছুটে চললো। এতক্ষণ লালমোহনবাবু জানালা দিয়ে তিস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন; সেবক ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন, ‘‘মিত্তিরমশাই! এখানকার সব লোকের মুখেই দেখছি হাসি লেগে আছে! হেসে হেসে লোকেরা বাজার-হাট করছে, হেসে হেসে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, এমনকি চা-শ্রমিকরাও হাসছে!’’ ব্যাপারটা আমিও অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করেছি। ফেলুদা পকেট থেকে একটা চারমিনার ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললো, ‘‘এটা আর নতুন কি! ২০১১-পর থেকেই তো পাহাড় হাসছে।’’

দার্জিলিং পৌঁছে হোটেল ঠিক পেতে আবার সমস্যা। যে হোটেলেই যাচ্ছি সবার একই শর্ত, তাদের হোটেলে থাকলে তাদের রেস্টুরেন্টেই খেতে হবে, তাদের গাড়ি নিয়েই সাইট-সিইং-এ যেতে হবে। লালমোহনবাবু রেগেমেগে ম্যানেজারকে বলেই ফেললেন, ‘‘ইউ মেক দার্জিলিং অ্যাজ নিউটাউন-রাজারহাট! সিন্ডিকেটরাজ! আই উইল কমপ্লেন ম্যাডাম। দেয়ার আর সো মেনি সব্যসাচী ইন ইওর সুইজারল্যান্ড।’’ ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন। তারপর ম্যানেজারের কাছে থেকে চাবি নিয়ে রুমে গেলেন।

লালমোহনবাবুর ডাকে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফেলুদা দেখি টিভিতে আইপিএল দেখছে। ম্যালের দিকে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বললো, ‘‘ম্যাচটা জমে গেছে। তোরা ঘুরে আয়, আমি কাল যাবো।’’ অগত্যা আমি আর লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লুম ম্যালের উদ্দেশ্যে। এটা সেটা নানান দোকান ঘুরে রকমারি জিনিসপত্র দেখছি। হঠাৎ আমার নজর পড়লো একটা দোকানের দিকে। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘পেরেক কিউরিও শপ।’ আমি লালমোহনবাবুকে দোকানটা দেখাতেই উনি লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘‘এই দোকানটাই তো খুঁজছিলাম।’’ 

দোকানের ভিতরে ঢুকে দেখি কোঁকড়ানো চুলের, মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ফোনে কাকে বলেই চলেছেন, ‘‘কুৎসা, কুৎসা, কুৎসা, কুৎসা....।’’ আমাদের দেখে ফোনটা রেখে বললেন, ‘‘বলুন, কি ছবি লাগবে! আমার কাছে প্রচুর দুর্মূল্য ও প্রাচীন সব পোট্রেট পাবেন।’’ এই বলেই ভদ্রলোক একটার পর একটা ছবি দেখাতে লাগলেন। রাকেশ রোশনের চাঁদে যাওয়ার ছবি, রবীন্দ্রনাথের গান্ধীজীকে ফলের রস খাওয়ানোর ছবি, রামমোহন বিধানসভায় সতীদাহ আইন পাশ করার দাবিতে বক্তব্য রাখছেন তার ছবি, সিধো ও কান্‌হো-র সাথে ডহরবাবুও যে সেলফি তুলছেন তার ছবি। আমি তো অবাক হয়ে হাঁ করে সব দেখছি। লালমোহনবাবুর কিন্তু তাতেও মন ভরছে না। অবশেষে ভদ্রলোক আলমারির ভিতর থেকে একটি ছবি বার করে বললেন, ‘‘এটা আমার বেস্ট কালেকশন।’’ ছবিটা দেখে তো আমি হাঁ! বি জে পি-র নেতা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সি পি আই (এম)-র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন! একেবারে তাজ্জব কি বাত্‌! লালমোহনবাবু বেশ চড়া দামে ছবিটি কিনেও ফেললেন! একেবারে দোকানদারের মু মাঙ্গি কীমত্‌!

বাড়ি ফিরে লালমোহনবাবু তো রীতিমত গর্বের সঙ্গে ফেলুদাকে ছবিটা দেখালেন। কিন্তু ফেলুদা লালমোহনবাবুর কেনা ছবিটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘‘গাঙ্গুলিবাবু, এটা তো আসল ছবি নয়। এটা ফোটোশপ্‌ করা হয়েছে।’’ লালমোহনবাবুর চোখ একেবারে কপালে উঠে গেলো, ‘‘বলেন কি মিত্তির মশাই! আমার এত্তগুলো টাকা জলে গেলো! ব্যাটা আমাকে ঠকালো!’’ ফেলুদা বললো, ‘‘চিন্তা করবেন না লালমোহন বাবু, আপনি কাল সকালেই টাকা ফেরত পেয়ে যাবেন।’’ ফেলুদার কাছ থেকে আশ্বস্ত হয়ে লালমোহনবাবু ঘুমোতে গেলেন। আমিও শুয়ে পড়লুম। ফেলুদা তখনও তাঁর ল্যাপ্‌টপে কাজ করেই চলেছেন।

পরের দিন সকালে ফেলুদা আমাকে আর লালমোহনবাবুকে নিয়ে চললেন, ‘পেরেক কিউরিও শপ’-এর উদ্দেশ্যে। দোকানে ঢুকতেই গতকালের সেই ভদ্রলোক কম্পিউটারে কি সব কাজ করছেন। আমাদের দেখে উনি তাড়াতাড়ি উঠে এলেন। ফেলুদা বললেন, ‘‘আচ্ছা, আপনার কাছে কি ঐ ছবিটা আছে যেটাতে মমতাজ বেগম মোদীজীকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন?’’ ভদ্রলোক ফেলুদাকে একবার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘‘ধুস্‌! এমন ছবি আমি জন্মেও দেখিনি!’’ ফেলুদা পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। আমরা সবাই অবাক! দেখি সত্যিই ছবিতে মমতাজ বেগম মোদীজীকে লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন! ফেলুদা দোকানদারকে বললেন, ‘‘ফোটোশপ আমরাও জানি। এখুনি টাকাটা ফেরত দাও।’’ দোকানদার অবস্থা বেগতিক দেখে কোনো কথা না বলে সুড়সুড় করে লালমোহনবাবুকে সব টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।


চলে আসার সময় ফেলুদা দোকানদারকে বললেন, ‘‘আপনার পেছনে তিন আঁচড়ে আঁকা ১কোটি ৮৬লক্ষ টাকা দামের যে ছবিটি দেওয়ালে টাঙানো আছে সেটাও জাল। অরিজিনালটা সুদীপ্তর বাড়িতে আছে।’’

Wednesday 20 April 2016

কালীঘাটে কেলেঙ্কারি


গতকাল সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকখানার ঘরে বসে ফেলুদা টিভিতে খবর দেখছে, আর আমি সোফাতে শুয়ে শুয়ে বন্ধুদের সাথে হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ চ্যাট করছি। এমন সময় লালমোহনবাবু হাজির হলেন। হাতে একটা কাগজের তেল-জব্‌জবে ঠোঙা। আমি ঠোঙাটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘নিমাইয়ের তেলেভাজা’’। লালমোহনবাবু বিগলিত হেসে বললেন, ‘‘ভাই তপেশ, তুমি তো দেখছি কদিন পরে গোয়েন্দাগিরিতে তোমার দাদাকেও হার মানিয়ে দেবে। চলো, এখন তাড়াতাড়ি এগুলোর সদ্‌ব্যবহার করা যাক।’’

ফেলুদা তখনও খবরের মধ্যে ডুবে আছেন দেখে লালমোহনবাবু আবার বললেন, ‘‘ও! মিত্তির মশাই! খবর পরে শুনবেন, আলুর চপ যে ঠান্ডা হয়ে যাবে মশাই!’’ ফেলুদা টিভির সামনে থেকে উঠে এসে আমার পাশে সোফায় বসলেন। লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে ফেলুদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘এই গরমে রোজ রোজ আলুর চপ না খেয়ে, মাঝেমধ্যে একটু গুড়-বাতাসার জল খান। শরীরটা ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল থাকবে।’’

লালমোহনবাবু একসাথে দুটো চপ মুখে পুরে গলাধঃকরণ করতে করতেই ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘তা মশায়, ভোটের হাওয়া কি বুঝছেন!’’ ফেলুদা ফস্‌ করে একটা চারমিনার ধরিয়ে, লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, ‘‘চড়াম্‌ চড়াম্‌’’। লালমোহনবাবু বললেন, ‘‘এটা কি ভূতুড়ে কান্ড মিত্তির মশাই! ভোট হয়ে যাওয়ার তিন চারদিন পরেও কি করে ভোটের হার বাড়ে!’’ ফেলুদা হেসে বললেন, ‘‘এটা ঐ বাংলা সিরিয়ালের ভূতুর কাজ। হাইলি সাস‘পিসি’আস!’’

এমন সময় টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো। আমি ফোনটা রিসিভ করেই রীতিমতো স্ট্যাচু হয়ে গেলাম! ফেলুদার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম, ‘‘কা..কা..কালীঘাট থেকে পি..পি..সি।’’ ফেলুদা তড়াং করে লাফ উঠে গিয়ে ফোনটা আমার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ বলুন, হুঁ! হুঁ! কখন? কখন? আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আসছি।’’ ফোন রেখে ফেলুদা বললেন, ‘‘রেডি হওয়ার জন্য ফাইভ মিনিটস্‌ অনলি!’’ তড়িঘড়ি তিনজনে লালমোহনবাবুর নীল-সাদা অ্যাম্বাসাডরে চড়ে রওনা দিলাম কালীঘাটের উদ্দেশ্যে।

হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে ঢুকতেই ওনার ভাইপো আমাদেরকে গেস্টরুমে বসতে দিয়ে বললেন, ‘‘একটু অপেক্ষা করুন, পিসি এখুনি আসছে।’’ মিনিটপাঁচেক পরে তিনি হন্তদন্ত হয়ে গেস্টরুমে প্রবেশ করলেন। চোখ মুখ দেখে বোঝা গেলো, ব্যাপক চাপে আছেন। ফেলুদা ওনার সঙ্গে আমার আর লালমোহনবাবুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। লালমোহনবাবু তো রীতিমতো উত্তেজিত! উৎসাহের আতিশয্যে তিনি বলেই ফেললেন, ‘‘ম্যাডাম! আমি আপনার আঁকা ছবির দারুণ ফ্যান! আপনি কেন হঠাৎ ছবি আঁকাটা ছেড়ে দিলেন বলুন তো?’’ মুখচোখ দেখে বোঝাই গেলো, এমন প্রশ্নে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘আমিও আপনার উপন্যাসের একজন গুণমুগ্ধ পাঠক।’’ লালমোহনবাবু বললেন, ‘‘আপনি তো ভালো নামকরন করেন, যদি আপনি আমার আগামী উপন্যাসের নামকরণটা করে দেন তাহলে আমি নিশ্চিত ওটা বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান পাবে।’’ উনি মুচকি হেসে সম্মতি জানালেন। তারপর ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘মিত্তিরমশাই! আপনার সাথে আমার একটু প্রাইভেট কথা আছে, আপনি বরং আমার সাথে একটু ভেতরের কেবিনে আসুন।’’ ভাইপো দুটো ঠান্ডা স্প্রাইট এনে আমাকে আর লালমোহনবাবুকে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে পিসি বললেন, ‘‘তোমরা ততক্ষণ ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হও, আমরা এখুনি আসছি।’’ উনি ফেলুদাকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন।

লালমোহনবাবু অবাক হয়ে রুমটা দেখতে দেখতে আমাকে বললেন, ‘‘ভাই তপেশ! টালির বাড়িতে সেন্ট্রালি এসি, ভাবা যায়! সবই সুদীপ্তের অনুপ্রেরণা।’’ আমি বুঝলাম এতক্ষণে স্প্রাইট তার কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। ‘‘সিধি বাত, নো বাকওয়াস।’’ একটুর বদলে প্রায় একঘন্টা পর ফেলুদা ফিরলেন। কি কথা হলো ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করায় ফেলুদা শুধু একটু মুচকি হাসলেন।

চলে আসার সময় উনি লালমোহনবাবুকে মেমেন্টো হিসেবে একটা ‘কথাঞ্জলি’ গিফ্‌ট করলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় জানাবার সময় উনি ফেলুদাকে অস্পষ্ট সুরে করুণভাবে বললেন, ‘‘মিত্তির মশাই! বাঁচার কি কোনও উপায় নাই!’’ ফেলুদা কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনজনে গাড়িতে বসলাম। ড্রাইভার স্টার্ট দিলো একবার, দু’বার, তিনবার, তবুও কিছুতেই চালু হচ্ছে না। উনি দরজায় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘গাড়িটা খারাপ হয়ে গেলো নাকি মিত্তির মশাই!’’ ঠিক তখনই গাড়িটা চালু হলো। 

ফেলুদা জানালা দিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘‘আসলে এটা বাম আমলের গাড়ি তো! তাই মাঝেমধ্যে একটু সমস্যা করে।’’

Saturday 16 April 2016

দিদি অন-লাইন


অপারেটর = আমাদের দিদি এখন অন লাইনে!! দিদি, প্রশ্ন আসা শুরু হয়ে গেছে। এই যে প্রথম প্রশ্ন-‘‘দিদি, আপনি কি খেতে ভালোবাসেন?’’
দিদি = মুড়ি-তেলেভাজা আমার খুব প্রিয়, আর মিষ্টির মধ্যে ল্যাংচা।
অপারেটর = ‘‘দিদি, আপনার সাথে ডেলোতে আর কে কে ছিল?’’
দিদি = ঐ তো কুনাল, মুকুল আর সুদীপ্ত। মুকুল বলেছিল শিউলিকে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি বারণ করেছিলাম।
অপারেটর = ‘‘দিদি মদনদা কবে ছাড়া পাবে?’’
দিদি = ওকে তো আমরা ‘রাজনৈতিক শহীদ’ ঘোষণা করে দিয়েছি। তবে যদি ভোটের আগে মুখ ফস্‌কে কিছু বলে ফেলে, তাই একরকম বাধ্য হয়েই টিকিট দিয়েছি। মাতালটাকে কিছুই বিশ্বাস নেই!
অপারেটর = ‘‘আপনি আর এখন ছবি আঁকেন না কেন?’’
দিদি = সারাদিন তো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতেই কেটে যায়। তাছাড়া আমার অমন শাঁকচুন্নি মার্কা ছবি কিনবে কে? যে কিনতো সেই তো এখন জেলে!
অপারেটর = ‘‘দিদি, আপনার সময়ে রাজ্য ধর্ষণ, আর নারী নির্যাতনে শীর্ষে পৌঁছে গেছে।’’
দিদি = আরে, এটা তো গর্বের বিষয়! আজ আমরা দেশের মধ্যে প্রথম। আরে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন তো সব ছোট্ট ঘটনা! শরীর থাকলে যেমন জ্বর বমি হয়, তেমন ধর্ষণও হয়! তাছাড়া আমি তো রেট ঠিক করে দিয়েছি।
অপারেটর = ‘‘দিদি, টেটের রেজাল্ট কবে বার হবে?’’
দিদি = টাকা জমা দিয়েছ বাবু! আগে টাকা জমা দাও, তারপরেই বরং খোঁজ নিও কেমন।
অপারেটর = ‘‘দিদি, আপনি এতো টাকা ক্লাবগুলোকে দান করছেন, অথচ ডি এ বকেয়া কেন?’’
দিদি = ওঃ, তোমরা এমন সব প্রশ্ন করো না! আরে বাবা, ক্লাবের বেকার ছেলেগুলো একটু ফুর্তি-আনন্দ করবে না! দ্যাখো বাপু, জীবনে তিনটে জিনিস খুব দরকার: ‘Entertainment Entertainment, Entertainment’। সেই জন্যই তো আমি এতো মেলা-মোচ্ছব করে বেড়াই। আর সরকারি কর্মচারীদের বলি, ‘‘তোদের এতো এতো ছুটি দিচ্ছি, এমনকি শিবরাত্রি, জামাইষষ্ঠীতেও ছুটি দিচ্ছি, তাও ডিএ, ডিএ বলে চেঁচামেচি করিস! লজ্জা করে না!"
অপারেটর = নতুন প্রশ্ন: ‘‘দিদি, আপনার দলের অনেকেই চুরির দায়ে অভিযুক্ত। কেউ লোহা তো, কেউ চন্দন কাঠ। এদের বিরুদ্ধে আপনি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন?’’
দিদি = ‘বেচারা’গুলোকে সিপিএম ‘চক্কান্ত’ করে ফাঁসিয়েছে। আমি এর ‘তীব্ব পোতিবাদ’ করছি।
অপারেটর = এটা মনে হয় আমাদের লোক লিখছে: ‘‘দিদি, আই লাভ ইউ’’।
দিদি = আই লাভ ইউ টু....যাক অনেকক্ষণ বাদে একটা সৎ লোককে পেলুম। সেই কখন থেকে হার্মাদগুলো জ্বালিয়ে খেলো।
অপারেটর = দিদি, আবার একটা হার্মাদ এসে গেছে: ‘‘চা-শ্রমিকদের মৃত্যু মিছিল কবে বন্ধ হবে?’’
দিদি = আরে, সুইজারল্যান্ডে এমন অনেক ‘ছোট্টো’ ঘটনা ঘটে। DDLJ দেখিসনি! শাহরুখ বলেছিল, ‘বড়ে বড়ে দেশোমে অ্যায়সে ছোটে ছোটে ঘটনা হোতে হি রহতে হ্যায়!’’
অপারেটর = ‘‘দিদি, আপনার আমলে এতো সিন্ডিকেটরাজ কেন?’’
দিদি = ব্যাপারটা আমিও লক্ষ্য করছি। তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই, আমি সিন্ডিকেটমন্ত্রী সব্যসাচীকে বলেছি। ও বলেছে ভোটের পরেই এসব বন্ধ হয়ে যাবে।
অপারেটর = ‘‘দিদি নারদার ভিডিওতে আপনার নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে, এটা কি সত্যি!’’
দিদি = তাই ভাবছিলুম, নারদ এখনও এল না কেন! দ্যাখো ভাই, এটা গভীর ‘চক্কান্ত’। আমরা দলীয় তদন্ত শুরু করেছি। প্রথমে সীতারাম ইয়েচুরি ও সিদ্ধার্থনাথ সিং আমাদের সন্দেহের তালিকায় ছিল, এখন দেখছি এর পিছনে আরো বড় বড় মাথা অনেকেই জড়িত। তাই আমরা ওবামা, হিলারী ক্লিন্টন, পুতিন, বান কি মুন, এমনকি আই এস আই বা লস্করকেও সন্দেহের আওতায় রাখছি। জামাতকে আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি। আসলে এটা ‘ইন্টারন্যাশানাল চক্কান্ত।’
অপারেটর = দিদি, আবার আমাদের লোক: ‘‘পিসি, আপনি সত্যিই অগ্নিকন্যা! কমিশনকে যা ঝাড়লেন না! পুরো মাখ্‌খন..।’’
দিদি = ওরা জানে না, আমি কতটা রাফ্‌ এন্ড টাফ্‌। আমাকে এখানে পুঁতলে দিল্লিতে গিয়ে জন্মাবো। আরে, আমি ‘গুন্ডা কন্ট্রোল’ করি, আচ্ছা আচ্ছা অফিসারকে চাব্‌কে লাল করে দিয়েছি। আমাকে শো-কজের নোটিশ দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে! ও কোন হরিদাস পাল!
অপারেটর = ‘‘দিদি, উড়াল পুলটা ভাঙল কেন?’’
দিদি = আর কতোবার বলবো! ওটা বাম আমলের, বাম আমলের, বাম আমলের, বাম আমলের.......।
অপারেটর = ‘‘দিদি, এবারে নাকি জোট সরকার ক্ষমতায় আসছে!’’
দিদি = এই এই! চোপ্‌ চোপ্‌ চোপ্‌! এমন বললে আমি কিন্তু খেলব না। এই, এই অপারেটর অনেক সহ্য করেছি, এবারে এসব ঢপের কারবার বন্ধ কর। মাথা গরম হয়ে গেলে কোথায় খিস্তি মারতে শুরু করবো!
অপারেটর = দিদি, দিদি! শুনুন, শুনুন, এবারে একটা কবিতা বলার অনুরোধ আসছে। ও দিদি! ও দিদি!

(দিদি হাওয়াই চটি পরে, অ্যাপেলের আই-ফোনে কথা বলতে বলতে প্রস্থান করলেন)

Thursday 14 April 2016

কালীপিসির কোলাভাই


ভবানীপুরের কালীপিসির প্রচুর ট্যালেন্ট! পিসি যেমন তিন আঁচড়ে কোটি টাকার ছবি আঁকেন, তেমনই হঠাৎ আপন খেয়ালে হিং টিং ছট্‌ কবিতাও লেখেন। এমনকি পিসির মুড ভালো থাকলে, উর্দুতেও দু-চার কলি লিখে ফেলেন। বাংলা সাহিত্যে অপরিসীম জ্ঞান। প্রচুর পুঁথি পড়েছেন। শুধু পড়েই ক্ষান্ত হননি! নামকরণের ওপরে একটা আস্ত বইও লিখে ফেলেছেন।

পিসির ভাইপোরাই পাড়ার সবাইকে বলে বেড়ায়, ‘জানিস, আমাদের পিসি ডক্টরেট! বিলেত থেকে বাক্সবন্দি করে প্রচুর ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন।’ পিসি নিজেও দু-একবার নামের আগে ‘ডঃ’ লিখেছেন। তবে পাড়ার লোকের মনে প্রথম দিন থেকেই খটকা লেগেছিল। হাটে বাজারে এই নিয়ে কানাঘুষো চলতো, কিন্তু পিসিকে সাহস করে জিজ্ঞেস করার মুরোদ কারো হয়নি। আসলে কালীপিসি বড্ড ‘রাফ এন্ড টাফ’, গুন্ডা কন্ট্রোল করে। তার ওপর পিসির ‘বেচারা’ ভায়েরা যদি রাতে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেয়! তাই পাড়ার লোকেরা চুপ করে থাকতো।

তবে ঐ ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, আর ‘সততা’র জালি দেরিতে হলেও ধরা পড়ে। পিসির জালি সার্টিফিকেটের কথা তাই বেশিদিন চাপা থাকলো না। আর যেই খবরটা বাইরে এলো অমনি খিল্লি শুরু হয়ে গেলো। কালীপিসি রাতারাতি ‘জালিপিসি’ হয়ে গেলো।

তবে এমন মহান কৃতিত্বের অধিকারী যে পিসি একা তা কিন্তু নয়! পিসির অনুপ্রেরণায় তার ‘বেচারা’ ভাই-ভাইপোরাও এখন জাল সার্টিফিকেট বানাতে সিদ্ধহস্ত। পিসির এই মাথামোটা কোলাব্যাঙের মতন ভাইটা, ব্যাটা অকর্মার ঢেঁকি। কোনো কাজই ঠিকঠাক করতে পারে না। পিসি ওকে তার কারখানা চালাতে দিয়েছিল, সেটা সে লাটে তুলে দিতে বেশি দেরি করেনি। তারপর পিসি সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্কুলটা চালাতে দিয়েছে, কিন্তু তাতেও প্রতিদিন যেভাবে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে, পিসির বিরক্তির একশেষ! পিসি তো এখন ওকে ‘ব্যর্থ’ বলেই ডাকে।

ওমা! সেই ব্যর্থ ভাইটাও ডক্টরেট করার জন্য হঠাৎ খেপে উঠলো। অনেক খুঁজে খুঁজেও ইস্ট জর্জিয়া নামে মার্কিন মুলুকে কোনো ইউনিভার্সিটির হদিশ না পেয়ে শেষমেষ উত্তরবঙ্গের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুঁইমালির সাহায্যে ভুঁইফোড় জালি সার্টিফিকেট বের করে নিলো! তবে পাপ বাপকেও ছাড়ে না! দিনদুয়েক আগে হঠাৎ টেলিগ্রাম এলো, ব্যাটা পি এইচ ডি -এর থিসিসে দিব্যি নাকি অন্যের নোট কপি-পেস্ট করেছে। তবে পাড়ার লোক এতে আদৌ অবাক হয়নি। তারা বলছেন- ‘‘সারাজীবন যে ছেলেটা টুকলি করেই পাশ করছে, সে কপি-পেস্ট করবে না তো কি করবে!’’ লোকেদের কানাঘুষোতেই জানা গেলো, সত্তরের দশকে নিউ আলিপুর কলেজে একা একটা ঘরে বইখাতা নিয়ে বসে পরীক্ষকদের ‘বদান্যতা’য় পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে কোলাভাই। সেই সার্টিফিকেট আর দাদাদের হাত মাথায় থাকার জোরে মস্ত চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিল। তবে তাও না টেঁকায় দিদির শেল্টারেই এখন রয়েছে।

কালীপিসি কিন্তু এসব কেয়ার করে না। তার কাছে যোগ্যতা এটাই। এমনকি, পিসির যার সঙ্গে ইন্টুমিন্টুর কথা শোনা যায় সেই নরেন মুদির এক দুঃসম্পর্কের বোনেরও এমন কীর্তি আছে। জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে বিয়ে করে দিব্যি বৌমা হয়ে সংসার করছিলেন। কিন্তু যেদিন বৌমা থেকে তিনি শাশুড়ি হলেন, সেদিন সন্দেহের বশে নিজের বৌমার সার্টিফিকেট পরীক্ষা করতে গেলেন। কারণ ঐ একটাই ‘কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি!’ কিন্তু মর্ডান বৌমা উল্‌টে শাশুড়িকেই হিপনোটাইজ করে তার ‘স্মৃতি’-তে তল্লাশি চালিয়ে সব সত্যি বের করে নিলো।


পাড়ার প্রবীণেরা বলাবলি করে, ‘‘পিসির পুরো বংশটাই জালি। এই রোগ সারবার নয়!’’ আর পাড়ার ছেলে-ছোকরাগুলোতো এখন কালীপিসির কোলাভাইকে দেখলেই বলছে, ‘জালি পিসির জালি ভাই’।

Tuesday 12 April 2016

তুমি মস্ত চোর (Tumi Mosto Chor)

ক্লাস এইটের ইতিহাস পরীক্ষায় ৪ নম্বরের টীকা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে লৌহমানবের ভূমিকা’ লিখতে গিয়ে যখন পকেট থেকে মাইক্রো-জেরক্সটি বের করে, তখনই হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় নিজাম আলির ছোট ছেলে কোহ্‌রাব। হ্যাঁ, ওটাই ছিল কোহ্‌রাবের চুরিবিদ্যার হাতেখড়ি। এরপর মাধ্যমিকে আবার টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। না, না, ইতিহাস নয়! এবার ভৌতবিজ্ঞান। স্টেইনলেস স্টিলের কম্পোজিশন। যখন কলেজে পড়ে তখন বাবার পকেট থেকে ৫০০ টাকা চুরি করে বন্ধুদের নিয়ে কলেজ বাঙ্ক করে চলে যায় আইনক্সে সিনেমা দেখতে। ফার্স্ট ডে, ফার্স্ট শো। আয়রন ম্যান।

চুরিবিদ্যাটা ততদিনে ভালোরকমই রপ্ত করে নিয়েছে কোহ্‌রাব। আর লোহার প্রতি তার ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলছে। পাড়ার লোক তাকে ‘চুম্বক’ বলেই ডাকে। পুকুরঘাটে কারোর লোহার বালতি বা অন্য কোনো বাসন হারিয়ে গেলে ডাক পড়তো কোহ্‌রাবের। সে একটা ডুব মেরেই নিমেষে তুলে আনতো হারিয়ে যাওয়া বাসন। তবে তার ছিঁচকে চোর বদনামের জন্য আশেপাশের পাড়ার লোক বাড়ির বাইরে লোহার জিনিসপত্র কোনদিনই ফেলে রাখতো না।

তারপর অনেকদিন হয়ে গেছে। দামোদর দিয়ে যেমন অনেক জল বয়ে গেছে, ঠিক তেমনই রানীগঞ্জে অনেক লোহা তৈরি হয়েছে। সেই কোহ্‌রাব এখন আর আগের কোহ্‌রাব নেই। সে অনেক বড় হয়ে গেছে। তার অনেক নাম ডাক হয়েছে। সে চোরেদের অ্যাসোসিয়েশন Tumi Mosto Chor-এ নাম লিখিয়েছে।

মস্ত বড়ো সেই অ্যাসোসিয়েশন। প্রচুর নামকরা চোরেরা সেই অ্যাসোসিয়েশন-এর মেম্বার। কেউ বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু চুরি করে তো, কেউ গন্ধ শুঁকে চন্দন কাঠ চুরি করে। কেউ বদহজমের জন্য ত্রিফলা চুরি করে তো, কেউ সেবার নামে ত্রাণ চুরি করে। কেউ পরীক্ষার প্রশ্ন চুরি করে তো, কেউ নারীদের সম্মান চুরি করে। কেউ কৃষকের আশা চুরি করে তো, কেউ বেকারের স্বপ্ন চুরি করে। নিজেদের মধ্যেই যেন প্রতিযোগিতা চলছে কে কত বড়ো চোর তা প্রমাণ করার। কোহ্‌রাব এই অ্যাসোসিয়েশন Tumi Mosto Chor-এর মেম্বার। সেও কম যায় না! চুরি বিদ্যাতে সে ছোটবেলা থেকেই দক্ষ। আর লৌহ প্রেম তো তার রক্তেই ছিল। তাই তার প্রথম নজর যে ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ওপর পড়বে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

এবারেও কোহ্‌রাব ধরা পড়ে গেলো। হলো দু’বছরের জেল। অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফ থেকে তার জামিনের আবেদন করা হয়। অ্যাসোসিয়েশন -এর কর্ণধার মিসেস ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। আদালতে জামিনও মঞ্জুর হয়। এরপর সংগঠনের পক্ষ থেকে মিসেস ব্যানার্জি ঘোষণা করেন, ‘‘বেচারা কোহ্‌রাব আজ ষড়যন্ত্রের শিকার। ওর মতন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ চোর আমাদের সংগঠনের সম্পদ।’’

মিসেস ব্যানার্জি আরো বললেন, ‘‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে কোহ্‌রাব আপাতত কিছুদিন বিশ্রাম নেবে এবং তার পরিবর্তে কোহ্‌রাবের স্ত্রী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে সমস্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কোহ্‌রাব, তার স্ত্রীকে সবরকমভাবে সাহায্য করবে। আমরা আশা রাখছি কোহ্‌রাবের স্ত্রী, তার স্বামীর যোগ্য উত্তরসুরীরূপে খুব শীঘ্রই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। জয়, মা-মাটি-চোরেদের জয়। জয়, Tumi Mosto Chor-এর জয়।’’


সংগঠনের নেত্রীর কথামতন কোহ্‌রাব তার স্ত্রীর হয়ে প্রাণপণ খাটতে লাগল। স্ত্রীর ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরছে এখন কোহ্‌রাব। রানীগঞ্জের চোরেদের সাথে কোহ্‌রাবের বহুদিনের পরিচয়, তাই তাদেরকে বারবার ফোনে স্ত্রীর হয়ে প্রচার করার নির্দেশ দিতে লাগল। এমনকি পুলিশের সামনেই কোহ্‌রাব রানীগঞ্জের সাধারণ মানুষদের ধমকাতে লাগলো, ‘‘আপনারা যদি আপনাদের বাড়ির লোহার জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখতে চান তাহলে আমার স্ত্রীকে সমর্থন করুন।’’ এখন দেখার রানীগঞ্জের মানুষ কি চোরের হাতে তাদের সিন্দুকের চাবি তুলে দেয় কিনা!

Monday 11 April 2016

সখী, ঘুষ কাহারে বলে

সখী,    ঘুষ কাহারে বলে,
সখী,    অনুদান কাহারে বলে।

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী    অনুদান’ ‘অনুদান’—
        সখীঅনুদান কারে কয়!  সে কি কেবলই নারদাময়।
        সে কি কেবলই হাতের মল?   সে কি কেবলই সি বি আই-র শ্বাস?
        লোকে তবে করে   কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ।
                
আমার চোখে তো সকলেই শোভন,
        সকলেই মির্জা, সকলেই হাকিম,    সুনীল আকাশ, মুকুল মদন,
        বিশদ জোছনা, কুসুম কাকলিসকলেই আমার মতো।
        তারা  কেবলই হাসে, কেবলই গায়,   অনুদান লইয়া মরিতে চায়
        না জানে বেতন, না পায় মদন,   না জানে সাধের যাতনা যত ।
      
টাকা সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,   পুলিশ হাসিয়া মিলায়ে যায়,
        হাসিতে হাসিতে সূর্যসাগরে   মানুষের ভোট হারায়ে যায় ।
        আমার মতন সুখী কে আছে,   আয় সখী, আয় আমার কাছে
        সুখী হৃদয়ের সুখের গান   শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
      
প্রতিদিন যদি নারদ আসে    একদিন নয় কাঁদিবি তোরা
        একদিন নয় অনুদান লয়ে    সকলে মিলিয়া জেলে যাবো মোরা।....

(কবিগুরুর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী)
সৌজন্য: অঞ্জন মুখোপাধ্যায়


Friday 8 April 2016

লন্ডনের মেয়র সঙ্গে চাদর রাখে?




সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরছি, এমন সময় রাস্তার পাশে বাঁশবাগানের ভিতর থেকে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে মনে হলো; যেন কেউ হাসতে হাসতে আর কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না। উঁকি মেরে দেখি একটা জন্তু-হেলে না এঁড়ে, পান্ডা না গিরগিটি, হনু না ভাল্লুক, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না-খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর বলছে, ‘এই দিলো দিলো, নারদ হুল ফুটিয়ে দিলো।’

হঠাৎ আমায় দেখে সে একটু দম পেয়ে উঠে বলল, ‘ভাগ্যিস্‌, তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাচ্ছিলো।’

আমি বললাম, ‘তুমি এমন সাংঘাতিক রকম হাসছো কেন?

জন্তুটা বলল, ‘হাসছি কেন শুনবে? কলকাতা যদি লন্ডন হতো, মেয়র তাহলে কোট-প্যান্ট পরতো, চাদর নিশ্চয়ই সঙ্গে রাখতো না। তাহলে অতগুলো ঘুষের টাকা কি করে ঢাকা দিতো? হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ!!’ এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আমি বললাম, ‘কি আশ্চর্য! এর জন্য তুমি এতো ভয়ানক হাসছ?

সে হাসি থামিয়ে বলল, ‘না না, শুধু এর জন্য নয়। মনে করো একটা ডাক্তার তাঁর এক পেশেন্টকে ডায়ালিসিস করাতে গিয়ে, তাঁর কুকুরের ডায়ালিসিস করে দিলো! হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ হা!’- আবার সেই বেদম হাসির পালা!

আমি বললাম, ‘কেন তুমি এই সব অসম্ভব কথা ভেবে খামোকা হেসে কষ্ট পাচ্ছো?

সে বলল, ‘না না না না না, সব কি আর অসম্ভব? মনে করো, একদিন দুটো পুলিশ একটা গাড়ি করে টেটের প্রশ্ন নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ প্রশ্নগুলি লাফ দিয়ে জানালার বাইরে বেরিয়ে গেল, রাস্তার পাশেই একটা ছাগল ছিল, সে সব প্রশ্ন খেয়ে নিল। হোঃ হোঃ হোঃ।’

জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে? তোমার নাম কি?’ সে খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘আমার নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌। আমার ভায়ের নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার ভাইপোর নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার ভাইঝির নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌..।’ আমি বললাম, ‘তার চেয়ে সোজা বললেই তো হয় যে তোমার গুষ্টিশুদ্ধ সবাই হিজিবিজ্‌বিজ্‌ ।’

সে আবার খানিক ভেবে বললো, ‘তা তো নয়, আমার বাবার নাম পরিবর্তন। আমার খুড়োর নাম পরিবর্তন, আমার মেসোর নাম পরিবর্তন, আমার দিদির নাম পরিবর্তন..।’

আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘সত্যি বলছ? না, বানিয়ে?’ জন্তুটা কেমন যেন থতমত খেয়ে বললো, ‘না না না না, আমার দিদির নাম সততা।’ আমার ভয়ানক রাগ হলো, তেড়ে বললাম, ‘না, তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না।’

অমনি কথা নেই, বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে একটা ছাগল হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে বুঝি ?

আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘না’, কিন্তু কিছু বলার আগেই সে তড়বড় করে বলে যেতে লাগলো, ‘তা তোমরা যতই কুৎসা রটাও, চক্রান্ত করো, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না। তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে- ‘ছাগলে কি না খায়।’

এই বলে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল: ‘হে, মা-মাটি-মানুষ এবং স্নেহের হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার গলায় ঝুলানো ইস্ট জর্জিয়ার ডক্টরেট সার্টিফিকেটটা দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রীমতি ব্যাকরণ শিল, DA, খাদ্যসাথী বিশারদ। এই চোপ! চোপ! কেউ কোনো কথা বলবে না। আমি কি বলছি সবাই শোনো। আমি খুব চমৎকার ‘ব্যা’ করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ। আর শিল তো যেখানেই যাই, সঙ্গে নিয়ে যাই। সুযোগ পেলেই ইঞ্চি মেপে পুঁতে দিয়ে আসি। ইংরিজিতে লিখবার সময় লিখি DA, যেটা সর্বদা বকেয়াই থাকে। কোন্‌ কোন্‌ জিনিস খাওয়া যায়, আর কোন্‌টা কোন্‌টা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে নবান্নে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যসাথীবিশারদ।’

একদমে নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যাকরণ শিল আবার শুরু করলো, ‘তোমরা যে বলো, সোনালী কি না বলে, ছাগলে কি না খায়—এটা ভারী অন্যায়। এই তো একটু আগে ঐ হতভাগাটা বলছিল যে ছাগল টেটের প্রশ্ন খায়। এটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা আমি স্বীকার করছি যে ছাগলে তেলেভাজা মুড়ি, ল্যাংচা, লাড্ডু, এমনকি ঝালমুড়ির ঠোঙা পর্যন্ত খায়। আমার ভাইপো তো একবার ভরা জনসভায় সপাটে গালে খেয়েছিল। আজকাল শিক্ষিত ছাগল, খেলোয়াড় ছাগল, ডাক্তার ছাগলও ভগবানের (নারদ) প্রসাদ খেয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে দু-একজন আবার ইঁট, বালি, সিমেন্ট খেতে ভালো বাসে। তবে সবাই নয়! এটাকে নেহাত ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলতে পার। আমার ছোটভাই মদন তো বিন্দু বিন্দু করে গোটা সিন্ধুই খেয়ে ফেলেছিল’- বলেই ব্যাকরণ শিল আকাশের দিকে চোখ তুলে ব্যা ব্যা করে ভয়ানক কাঁদতে লাগলো।

তাতে বুঝতে পারলাম যে ভাইটি শহীদ হয়েছে। হিজিবিজ্‌বিজ্‌টা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ ছাগলটার বিকট কান্না শুনে সে হাঁউ-মাঁউ করে ধড়মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির! আমি ভাবলাম বোকাটা মরে বুঝি এবার! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা ছুঁড়ে ফ্যাক্‌ ফ্যাক্‌ করে হাসতে লেগেছে।

আমি বললাম, ‘এর মধ্যে আবার হাসবার কি হল?’ সে বলল, ‘সেই একজন লোক ছিল, সে সবসময়ই ‘অন’ হয়ে থাকতো, তার পর-নারীর সাথে সম্পর্ক ছিলো। একদিন এক দালাল টাকা খেয়ে তার সব কেচ্ছা সবাইকে বলে দিয়েছে-হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—।’

এমন বেমক্কা হাসির মধ্যে হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন আমাকে টানছে। ঘোর কেটে যেতে দেখলাম, আমি সন্ধ্যাবেলাতেই বারান্দার চাটাইতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর সেই সুযোগে পাশের বাড়ির রামু গোয়ালার ছাগলটা ঢুকে আমার চাদরটা চিবোতে আরম্ভ করেছে। আমিও এরকম উটকো স্বপ্নের কথা ভেবে হাসতে শুরু করলাম, ‘সত্যিই! ছাগলে কি না খায়!’


(সুকুমার রায়ের হিজিবিজ্‌বিজ্‌ ও রামছাগল অবলম্বনে)

Monday 4 April 2016

লন্ডভন্ড লন্ডন


@পাগলা দাশু

লন্ডন ব্রিজ ইজ ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন, মাই ফেয়ার লেডি,”- এই রাইমস্‌টা ছোটবেলায় পড়েছিলাম। তখন কি আর জানতাম, কলকাতা একদিন লন্ডন হবে, আর সেখানেই আবার ব্রিজ ভেঙে পড়বে, আর আমাদের সকলের প্রিয় মাই ফেয়ার লেডিদায় এড়ানোর জন্য বলবে এই ব্রিজ আমাদের আমলে তৈরি হয়নি। অথচ যে সমস্ত ব্রিজ ফ্লাইওভার ওনার আমলে শুরু হয়নি, কিন্তু শেষ হয়েছে ওনার আমলে, তাতে নীল সাদা রং করে, ঢঙ করে বলতে শোনা গেছে এই উন্নয়ন আমরা করেছিওনার প্রতি কোনো মমতা নেই, তাই এই নীল-সাদা গিরগিটির ভোটও নেই।

ওনার যা যুক্তি, তাতে হাওড়া ব্রিজের কিছু হলে তো তার দায় নিতে হবে ব্রিটিশদের। আর দিল্লি রোডে ধস্‌ নামলে দায় নিতে হবে মোঘলদের। হাজারদুয়ারী এলাকায় কোন সৌধ ভেঙ্গে পড়লে কবর থেকে তুলে আনতে হবে নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলাকে। পাগলের রাজত্ব।!!!

ঠান্ডা মানে কুল

ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
পচে গেছে ঘাস ফুল।
ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
ফেঁসে গেছে তৃণমূল।
ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
ঘুষ খেয়ে যে করল ভুল।
ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
নেতারা সব ছিঁড়ছে চুল।
কুল কুল ঠান্ডা ঠান্ড়া,
ভোটে এবার পাবে আন্ডা।
ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
দিদি সভায় মারছে গুল।
ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,
ভয় পেয়েছে আরাবুল।
কুল কুল ঠান্ডা ঠান্ডা,

জিতবে এবার লাল ঝান্ডা।

আবার ভোট

--------
ইবারটোও যে ওঁনারা !!!
-‘‘চোখে স্বপ্ন !
নতুন দেশ নতুন জীবন !
স্বপ্নহারা মুখগুলো ফিরে পাবে
ভরসার ঠাঁই ! বিশ্বাসের জন !
তাই,আটপৌরে জীবনটা
সুখ-শান্তির ভরসায় সাজাবে !!’’-
ঐদিকটো ! খাল পাড়ে !
- ও’নারা !!
-‘‘ডেকিছেন ! কি’-লাবে !
-''অভূক্ত পেটগুলো নেচে ওঠে !
''বিরিয়ানী-পোলাও''-র উলঙ্গ
শরীরটা ভেবে ''-। গতবার !!
''পুঁচকেটা''-ছোট্অটো ছিলো !
মাংসের টুকরাগুলা'' নিয়ে খেলেছিলো
লতুন খেলনা ভেবে !!
''-বড়ো উদার! দিলদার গো !!
কত কি দ্যায় !! চাল, টাকা,
পুচঁকের জন্য জামা ,
আর পুঁচকের মাকে ??
---একটা হেব্বি শাড়ি !
আর আমায় !! একটা গোটা বিলেতী ''ন্যাপা''!!''-আর
-সিগ্‌রেটের পাকেট !!
না বাবু ! বেইমান লই !
গরীব হতে পারি !!
''নিমকহারাম'' লই ।
দিয়ে এলাম !! দুজনেই !
দু’ দুট্‌টো ভোট !!
''-পুঁচকের মা'কে
না !! হেব্বি  লাগছিল !
রোজ ''একটা'' দেখি আজ যে দু’ দু'টো !!!
শাললা হেব্বি  হতো ,

ভোট'টা যদি রোজ হতো !!